রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আন্তর্জাতিক

ব্রেক্সিট ঘূর্ণিঝড়ে ব্রিটিশ রাজনীতি

এত দিন অভিবাসন বিষয়ে ইইউয়ের যেসব নীতিমালা ছিল; সেগুলো মানতে হতো তাকে। ব্রিটেনে কর্মরত ইউরোপের অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের কারণেই অনেকে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ওইসব নাগরিক তাদের কাজ দখল করে নিচ্ছে বলে তাদের অনেকেই অপছন্দ করেন। কিন্তু ব্রিটিশরাও ইইউভুক্ত দেশে কাজ করছেন। তাদের জন্যও তৈরি হবে অনিশ্চয়তা। দুই পাশের যাতায়াত ভিসা আর কাজের পারমিট পাওয়ার বিষয়টির কারণে তা সময়সাপেক্ষ হয়ে যাবে। হঠাৎ করে বদলে যাবে বহু অভিবাসীর জীবন। কিন্তু আবার ব্রিটিশদের অনেকেই সেখানে বসবাসরত অন্যান্য দেশের অভিবাসী যেমন এশিয়া বা আফ্রিকার দেশের অভিবাসীবিরোধী। লন্ডনের বার্কিং অ্যান্ড ডাগেনহ্যাম কাউন্সিলের কাউন্সিলর এবং লন্ডনে বাঙালি কমিউনিটির একজন নেতা সৈয়দ ফিরোজ গনি বলছেন, একটা অনিশ্চয়তা রয়েছে সেখানকার সব অভিবাসীর ওপরও। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি বাতিল হওয়ায় হতাশ অনেক ইউরোপীয় দেশ। এর মধ্যে অনেক দেশই বলছে, তারা এ চুক্তি নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি নয়। জার্মানির মতো দেশ এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে টেরেসা মের সঙ্গে যে খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান। কারণ এর আওতায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসাকে খাপখাইয়ে নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সময় দেওয়া হবে। তার পরও কথা থেকে যায়। এখন কী করবেন টেরেসা মে? ব্রিটেনইবা যাবে কোন পথে? হাউস অব কমন্সে ব্রেক্সিট চুক্তিটি বাতিল হওয়ায় এখন অনেক সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে।

যেহেতু ইইউভুক্ত দেশগুলো আর চাচ্ছে না ব্রেক্সিট নিয়ে আবার ব্রিটেনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায়; সেহেতু কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই অনেকটা অগোছালভাবে ২৯ মার্চ ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। এতে ব্রিটেন অনেক সমস্যার মধ্যে পড়বে। ইইউভুক্ত ২৭টি দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে কাস্টমস চুক্তি করতে হবে ব্রিটেনকে। আমদানি-রফতানি শুল্কহার নির্ধারণ করতে হবে। ব্রিটিশ পাউন্ডের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরোর মান নতুন করে নির্ধারণ করতে হতে পারে। ব্রিটেনের যেসব নাগরিক এখন ইইউভুক্ত দেশে কাজ করেন কিংবা ইইউয়ের যেসব নাগরিক ব্রিটেনে কাজ করেন, তাদের স্ট্যাটাস কী হবে; সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। ইইউয়ের নাগরিকরা ২৭টি দেশের যেকোনো একটি দেশে কোনো ধরনের ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই কাজ করতে পারতেন, ২৯ মার্চের পর নতুন করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাজ্যের বড় ট্রেডিং পার্টনার হচ্ছে জার্মানি। যুক্তরাজ্য জার্মানি থেকে আমদানি করে বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য। এ পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের চেয়ে বেশি। হল্যান্ড থেকে আমদানি করে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড, ফ্রান্স থেকে আমদানি করে প্রায় ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড, স্পেন থেকে ৩০ বিলিয়ন পাউন্ডের পণ্য। অথচ রফতানি করে কম। জার্মানিতে রফতানির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন পাউন্ড, ফ্রান্সে ৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড। এখন ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে আমদানি-রফতানিতে এর প্রভাব পড়বে। ব্রিটেনে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে। বলা ভালো, ২০১৭ সালে ব্রিটেন ইইউভুক্ত দেশগুলোতে মোট রফতানি করে ২৭৪ বিলিয়ন পাউন্ড।

চলতি মাসের ১৫ জানুয়ারি ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে ব্রেক্সিট চুক্তি নাকচ হওয়া এবং এর পরপরই আস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের টিকে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ কী? ব্রিটেনের গণভোটে ২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার পক্ষে রায় পড়েছিল। ওই রায়ে ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চার দশকের সম্পর্কের অবসান ঘটেছিল। ওই সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কনজারভেটিভ দলের ডেভিড ক্যামেরন। তিনি পদত্যাগ করলে একই দলের টেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুই বছর ধরে টেরেসা মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছেন। আইন অনুযায়ী আগামী ২৯ মার্চের মধ্যে ব্রিটেনকে ইইউ ত্যাগের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। আর এ লক্ষ্যেই ১৫ জানুয়ারি টেরেসা মে পার্লামেন্টে ভোটাভুটির জন্য তার খসড়া চুক্তি উপস্থাপন করেন। এ ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। কিন্তু টেরেসা মে জানতেন তিনি এ খসড়া চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করাতে পারবেন না। এজন্য তিনি ভোটাভুটি কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। তার খসড়া চুক্তিটি অনুমোদিত হয়নি। তবে একটা প্লাস পয়েন্ট তার জন্য, তার দল এখনো তার ওপর আস্থা রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রয়ে যাচ্ছেন। এখন ব্রেক্সিটের কী হবে? হাউস অব কমন্সে ভোটাভুটিতে দেখা গেছে, ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট পড়েছে ২০২ আর বিপক্ষে ৪৩২। মোট আসন ৬৫০। ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে বিভক্তি আছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বে কনজারভেটিভদের ১১৮ জন এমপি চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন আর দলের ১৯৬ জন এমপি পক্ষে ভোট দিয়েছেন।

অন্যদিকে ২৪৮ জন লেবার পার্টির এমপি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। প্রস্তাবের বিপক্ষে অন্যান্য দলের ৫৬ জন এমপিও ভোট দিয়েছেন। ফলে এটা স্পষ্ট যে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে ব্রিটেনের সমাজে বড় ধরনের বিভক্তি রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও টেরেসা মের ওপর আস্থা রেখেছে তার দল। আস্থা ভোটে তিনি পেয়েছেন ৩২৫ ভোট আর বিপক্ষে পড়েছে ৩০৬। আস্থা ভোটে টেরেসা মে হেরে গেলে ব্রিটেনে আবার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। এখন টেরেসা মে টিকে গেলেন বটে কিন্তু তাকে সব দলের সহযোগিতা নিয়ে একটি চুক্তি করতে হবে। অথবা এমনও হতে পারে কোনো চুক্তি ছাড়াই ২৯ মার্চ ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগ কার্যকরী হবে। তবে এতে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না! যদিও ইউরোপীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড ট্রাস্ক বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে একমাত্র বাস্তব সমাধান হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়া। কিন্তু এটি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো মহল থেকে দাবি উঠেছে যে, নতুন করে ব্রেক্সিট প্রশ্নে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা হোক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২৯ মার্চের আগে আর নতুন করে আরেকটি গণভোটের আয়োজন করা সম্ভব হবে না। কেননা গণভোটের জন্য নতুন একটি আইন তৈরি করতে হবে এবং বিধিবিধান তৈরি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সময় দিতে হবে। সুতরাং ২৯ মার্চের আগে এটি আয়োজন করা কোনো মতেই সম্ভব নয়। পাঁচ. টেরেসা মে পার্লামেন্টে জিতে গেলেও তিনি ব্রেক্সিট প্রশ্নে জনগণের সমর্থন পাওয়ার আশায় সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিতে পারেন। এতে তিনি যদি বিজয়ী হনও তাতে করে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে তেমন কোনো পরিবর্তন আনবে না, এমনকি নির্বাচনে তার দল অর্থাৎ কনজারভেটিভ পার্টির হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে লেবার পার্টি যদি বিজয়ী হয়, তারা ইইউতে পুনঃযোগদানের প্রশ্নে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এতে সংকট আরো বাড়বে। বড় জটিলতা তৈরি হবে। সুতরাং টেরেসা মে আগাম নির্বাচনের দিকে যাবেন বলে মনে হয় না। ছয়. ব্রেক্সিট ভোটের পর একটা বড় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে স্কটল্যান্ড নিয়ে। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অংশ। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদাভাবে স্বাধীন হতে পারে এবং এরপর ইইউর সঙ্গে থাকতে আবেদন করতে পারে। ব্রেক্সিট গণভোটের সময় স্কটল্যান্ডে যে ভোট হয়েছিল, তাতে ৬২ শতাংশ ভোট পড়েছিল ইইউতে থাকার পক্ষে আর ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছিল যুক্তরাজ্যের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা নিকোলা স্টুরজিওন আবার স্কটল্যান্ডে একটি গণভোটের ডাক দিতে পারেন। এখন মিস স্টুরজিওন কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই দেখার বিষয়। গত ১৫ জানুয়ারি হাউস অব কমন্সে ব্রেক্সিট চুক্তি নাকচ হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছে না পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাবে। ২৯ মার্চের পর ব্রিটেন যদি সত্যি সত্যিই বেরিয়ে যায়, তা হলে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতন ত্বরান্বিত করতে পারে। দক্ষিণপন্থি জাতীয়তাবাদীরা বিভিন্ন দেশে তাদের অবস্থান এখন আরো শক্তিশালী করবে। ফ্রান্স, গ্রিস, এমনকি ইতালি হচ্ছে পরবর্তী রাষ্ট্র; যারা ব্রিটেনের পথ অনুসরণ করতে পারে। ফ্রান্সের কট্টর দক্ষিণপন্থি নেতা মেরিন লি পেন ও তার দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট সেখানে আবারও গণভোটের ডাক দিতে পারে। তার দল ফ্রান্সকে ইইউ থেকে বের করে নিয়ে আসতে চায়। জার্মানিতে দক্ষিণপন্থিরা আরো শক্তিশালী হবে। তারা এই প্রথমবারের মতো জার্মান পার্লামেন্টে গেছে এরা জার্মানির ইইউ ত্যাগ করার ডাক দিতে পারে।

এমনকি ইতালিতেও এ কট্টরপন্থিরা ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর শক্তিশালী হয়েছে। নর্থান লিগ ও এর নেতা ম্যাটিও সালভিনি প্রচন্ডভাবে ইইউবিরোধী। ইইউয়ের অন্যান্য দেশেও এই দক্ষিণপন্থি উত্থান লক্ষ করার মতো। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে টেরেসা মে যাচ্ছেন। তিনি এরই মধ্যে পার্লামেন্টের সব দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। কিন্তু তা কী ফল বয়ে আনবে, তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার যাত্রা শুরু করেছিল। আজ ২৫ বছর পর সেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়ল। ইইউ নামে এটি যাত্রা করলেও এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আরো আগে ১৯৫৮ সালে। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৭ সালে ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশন গঠন, ২০০২ সালে একক মুদ্রা চালু করার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্ব আসরে আবির্ভূত হয়েছিল। প্রায় ১৯ দশমিক ২০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, এই অর্থনীতি ইইউকে বিশ্ব আসরে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং রাজনীতি ক্ষেত্রেও অন্যতম শক্তিতে পরিণত করেছে। এখন ব্রিটেন চূড়ান্তভাবে বেরিয়ে গেলে ইইউয়ের শক্তিকে দুর্বল করবে। আগামী দুই মাস ব্রিটেনের জন্য অত্যন্ত কঠিন একটি সময়। আস্থা ভোটে টেরেসা মে টিকে গেলেন বটে। কিন্তু এটিই সব কথা নয়। সত্যিকার অর্থেই ব্রিটেনের জন্য ভবিষ্যতে এক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close