অলোক আচার্য

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

নিবন্ধ

নতুন প্রজন্মের ভাষাচর্চা

কো নো দেশের জন্য, কোনো জাতির জন্য ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক। ভারতীয় উপমহাদেশ বহু বছর ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। তাদের অধীনে থাকার কারণে ইংরেজি আমাদের অস্থিমজ্জায় গেঁথে গেছে। ব্রিটিশরা চেয়েছিল তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ওপর প্রয়োগ করতে। বহু বছরের শাসনের ফলে তাদের সে অভিপ্রায় আজ অনেকটা সফল। ভাষার অধিকার আদায়ে আমাদের গৌরবমন্ডিত ইতিহাস থাকলেও বিদেশি ভাষাচর্চার প্রতি আমাদের আগ্রহটাই বেশি। এমনকি নিজেদের ভাষা শুদ্ধভাবে না জানলেও বিদেশি ভাষাচর্চার কমতি নেই। ফেব্রুয়ারি এলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের কথা। বাংলা সমৃদ্ধিশালী ভাষা হলেও আমাদের কারণেই কোথায় যেন একটা ঢিলেঢালা ভাব চোখে পড়ে। হতে পারে বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশি ভাষা বললে প্রথমেই আসে ইংরেজি ভাষার কথা। এই ভাষাকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় যে, মনে করা হয় এটা ভালোভাবে আয়ত্ত না করলে জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে। তার মানে এই না যে, ইংরেজি বা অন্য ভাষা শেখার গুরুত্ব নেই। তাই বলে নিজ ভাষাচর্চার ওপরে অবশ্যই নয়। ছোটবেলা থেকে আমি বা আমার সহপাঠীরা যে লেখাপড়া করে বড় হয়েছি, সেখানে সারা বছরই আমাদের ইংরেজি প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। তারপরও যে বিষয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা ফেল করেছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ইংরেজি। শ্রেণিতে প্রায়ই পড়া না পারার জন্য বেতের পিটুনি ছিল নির্ধারিত। তাও কিন্তু বেশির ভাগ সময় ওই ইংরেজি ক্লাসেই খেয়েছি। অর্থাৎ সারা জীবনটাই কিন্তু বিদেশি ভাষা রপ্ত করতে করতে কাটিয়ে দিলাম কিন্তু তারপরও এই ভাষার ওপর কজনে কতটা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছি। অনেকেই তো কোনোমতে শিখে জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। শুধু স্কুলে কেন বাড়িতেও তো বাবা-মা বা মুরব্বি স্থানীয় ব্যক্তিরা সারাক্ষণ ইংরেজি পড় ইংরেজি পড় করেছে। বাংলাটা মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত, এ রকম কথা পরিবারে বা স্কুলে খুব কম শুনেছি বলেই মনে হয়। বিষয়টা এমন যে যেখানে বেশি সময় কাটালাম সেখানেই ব্যর্থতা চেপে ধরেছে বেশি। আজও কী আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইংরেজিভীতি কাজ করে না। কিন্তু যে সময় ইংরেজি বা অন্য ভাষা শিখতে ব্যয় করেছি, তার একটু অংশও যদি বাংলা শিখতে ব্যয় করতাম তাহলে কত ভালোই না হতো।

ছাত্রছাত্রীদের দেখি সকাল-বিকেল ইংরেজি গণিত বিজ্ঞান নিয়ে প্রাইভেটের পর প্রাইভেট পড়ছে। তা পড়–ক। অন্য ভাষা বা অন্য বিষয়ে চর্চায় তো আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার আপত্তি শুধু একটুখানি সময় আমার মায়ের ভাষার পেছনে ব্যয় করা। কী মধুর যে, এই ভাষা তা নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তা তো আর হয়ে ওঠে না। পৃথিবীর ২০ কোটিরও অধিক লোক বাংলায় কথা বলে। এটা ভাবতেই ভালো লাগে। অন্য ভাষা রপ্ত করতে গেলেও যে নিজ বুলিটা উত্তমরূপে আয়ত্ত করার প্রয়োজন হয়, সে কথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। বাইরের দেশের ভাষা শেখার একটা গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু তা কখোনই মাতৃভাষাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। যদি তা হয় তবে তা আত্মঘাতী।

ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। বংলা ভাষার প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ কতখানি, তা পরিমাপের একটা চেষ্টা করা হয়। আসলেই বিষয়টা এমন হওয়া উচিত? সারা বছর বাংলা নিয়ে চর্চা হবে। সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করার চেষ্টা করা হবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা মোটা মোটা বিদেশি সাহিত্যের বই নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত থাকবে না। এর একটা অংশ বাংলা বই নিয়েও কাটাবে। মোট কথা, শুধু-কাগজে কলমে নয় অন্তরে স্থান দিতে হবে বাংলাকে। তাহলেই অন্তর হবে শুদ্ধ। আর শুদ্ধ অন্তর দিয়ে যে ভাষাই আয়ত্ত করতে চাও না কেন, তা সম্ভব। এবার একটু বাংলা বানানের কথায় আসি। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেখেছি বানান ভুল হলে মার্কস কেটে নেওয়া হতো। আমরা অতি সতর্কতার সঙ্গে ইংরেজি বানান মুখস্থ করার মতো করেই বাংলা বানান মুখস্থ করতাম। যাতে পরীক্ষার খাতায় বানানের জন্য কোনো মার্কস কাটা না যায়। বানান ভুল হলে শিক্ষকরা তার নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে দিত। বাড়িতে যখন সে খাতা দেখাতাম খুব লজ্জায় পড়ে যেতাম। বলা চলে, ঘাড় ধরে সেই বানান শেখানো হতো। ফলে এমন হতো যে, যেখানে ভুল বানান চোখে পড়ত, মনে হতো সৌন্দর্যের একটা অভাব রয়েছে। তার মানে আমার যে ভুল হয় না তা না। তবে তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত। অনেক দোকানের ব্যানারে, রাস্তাঘাটের বিভিন্ন লেখায়, দেয়ালে দেয়ালে তাকালে চোখে পড়ে বানান ভুলের ছড়াছড়ি। দেখলে মনে হয় এরা যেন ভুল বানানের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অবশ্য বাংলা বানান সঠিক লেখার ওপর শহরের স্কুলগুলোতে কী হয় তা জানি না তবে মফস্বলের অনেক স্কুলেই যে বিষয়টার প্রতি সুনজর দেওয়া হয় না তা জানি। বানান লিখতে ভুল করলে আজ কোনো মার্ক কেটে নেওয়া হয় না। ফলে ছাত্রছাত্রী ভুল বানান লিখেই মার্কস পেয়ে যায়। এতে সঠিক বানান শেখার প্রতি সে আর জোর দিচ্ছে না। সে যে লিখতে চেষ্টা করেছে তাই তো যথেষ্ট! কিন্তু সে যে সঠিকটা শিখতে পারল না এটাই কষ্ট থেকে গেল। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, মোবাইলে বাংলিশ টাইপের এসএমএস দেখলে আমার ঠিক কী পরিমাণ কষ্ট হয়, তা বলে বোঝাতে পারব না।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সেই মহান আত্মত্যাগ, সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এসবকিছুই বাংলাকে নিয়ে গর্ব করার মতো যথেষ্ট। এ ছাড়া এ ভাষা নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বলার অনেক কিছু আছে। আমরা দরিদ্র নই। আমরা সমৃদ্ধ। আমাদের ভাষাসমৃদ্ধ। দরকার শুধু মুখের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর দিয়ে লালন করার ক্ষমতা। দেশে অনেক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রয়েছে। সেখানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার সঠিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ হলে ভালো হয়। আমি বারবার বলছি বর্তমান যুগে চলতে গেলে বিদেশি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু তা যে কোনোভাবেই মাতৃভাষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে তা আমি মানতে নারাজ। আমাদের প্রজন্ম, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। স্কুলগুলোতে শুধু ইংরেজি বা অঙ্ক বা বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি ভীতিসূচক গুরুত্ব না দিয়ে পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ এসব বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করতে হবে। মাতৃভাষার প্রতি যে মমতা তা খুব অল্প বয়স থেকেই শুরু করা উচিত বলে মনে হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close