মোতাহার হোসেন

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রয়োজন জিরো টলারেন্স

দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থা জিয়ে রেখে কখনো একটি দেশ সামনের দিকে অগ্রগতির পথে এগোতে পারে না। বিশ্বের বহু দেশ শুধু দুর্নীতির কারণে পিছিয়ে গেছে। সেই কারণে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে সামনের দিকে তথা সমৃদ্ধির পথে এগোতে হলে অবশ্যই দুর্নীতিকে পেছেন ফেলে সামনের দিকে এগোতে হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে তার ও তার সরকারের আন্তরিকতা, স্বদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতির প্রমাণ মেলে বিগত ১০ বছরের শাসনামলের তুলনামূলক বিচারে। এর আগে বিগত ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামল তুলনা করলে এই চিত্র সহজেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। কারণ, বিএনপির শাসনামলে পুরো পাঁচ বছরে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি কর্তৃক পাঁচ-পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

এতে জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ এবং জাতি হিসেবে আমরা দুর্নীতিগ্রস্তের তকমা উপহার পেলাম। এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। দুর্নীতি অব্যাহত থাকলে সুশাসন যেমনি ব্যাহত হয়, তেমনি ব্যাহত হয় দরিদ্রতা দূর করা। ব্যাহত হয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বার আর তার জীবনে এ নিয়ে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে গত ১৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার প্রতিষ্ঠায় তার দৃপ্ত অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। একইসঙ্গে প্রশাসনের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তার এই বক্তব্যে দেশের জনপ্রশাসনের ওপর স্তর থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি সতর্ক বার্তাও বটে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

এটি চির সত্য, উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশনা দেন। কারণ, একটি ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। উল্লেখ্য, বিগত সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তি উদ্যোগে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ক্ষেত্রে বিশেষে ৮০ থেকে ১২৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছেন। তখন সরকারি মহল থেকে বলা হয়েছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে অভাব ও দরিদ্রতা। তাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো গেলে কর্মকর্তাদের অভাব গুছবে, দরিদ্রতা হ্রাস পাবে। তখন দুর্নীতি কমবে, পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কমবে। কিন্তু বাস্তবে বিগত সময়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। আর এসব কারণেই প্রধানমন্ত্রী সেই প্রত্যাশা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই বৈঠকে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যেটা প্রয়োজন সেটা তো আমরা মিটাচ্ছি। তাহলে দুর্নীতি কেন হবে। মন মানসিকতাটা পরিবর্তন করতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আপনাদের দিতে হবে একদম তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত, যোগ করেন তিনি। টানা তৃতীয়বার সরকার গঠনের পর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শন কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এদিন পরিদর্শনে আসেন প্রধানমন্ত্রী। বিগত সময়ের মতো মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি বাড়াতে এবং সৃজনশীলতার বিকাশে এবারও পর্যায়ক্রমে সবগুলো মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করবেন প্রধানমন্ত্রী। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনা জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট একটি নির্দেশনা দিতে হবেÑ কেউ দুর্নীতি করলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘কারণ, যে হারে বেতন আমরা বাড়িয়েছি। এ উদাহরণ মনে হয় পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই।’ সন্ত্রাস-মাদক-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধেও আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তার সরকার সন্ত্রাস, মাদক এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে’ বলেন তিনি।

উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যায় পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘যে লক্ষ্য আমরা নিয়েছি তা আমরা পূরণ করতে পারব, তার জন্য প্রয়োজন সুশাসন, তার জন্য দরকার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা।’ জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের সততা-আন্তরিকতা নিয়ে জনসেবা করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা সরকার পরিচালনার মূল জায়গাটা হলো আপনাদের এই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অনেক বিশাল এক কর্মযজ্ঞ এখানে। সে ক্ষেত্রে আপনাদের দায়িত্ব কিন্তু অনেক অনেক বেশি। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রাণকেন্দ্র জনপ্রশাসন। আপনাদের সেভাবে কাজ করতে হবে, আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করার নির্দেশও দেন তিনি। তিনি বলেন, সবাইকে অনুরোধ করব, একটা কথা মনে রাখতে হবে, দেশটা আমাদের। আমরা এ দেশ স্বাধীন করেছি। আজ সারা বিশ্বে একটা সম্মানজনক জায়গায় আসতে পেরেছি।’ ৭১-এর পরাজিত শক্তি সেই পাকিস্তান এখনো আর্থ-সামাজিক সূচকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশকে অনুকরণ করতে চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন সেই পাকিস্তানও বলে আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও।’ আজকে কিন্তু আমাদের আর তলাবিহীন ঝুড়ি বলার সাহস তাদের নেই। কারণ আমরা অনেক এগিয়েছি। এই এগিয়ে যাওয়াটা, এই যাত্রাটা আমাদের কিন্তু অব্যাহত রাখতে হবে। জনপ্রশাসনে বিশেষ দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তার সরকারের জনপ্রশাসনর পদক প্রবর্তনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘কাজে কে কতটা দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখাতে পারছে, তার ওপর আমরা জনপ্রশাসন পদক প্রবর্তন করেছি।’ জনপ্রশাসনে পদোন্নতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে শুধু জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, এখানে দক্ষতাকেও প্রাধান্য দিতে হবে। কে কত বেশি সততার সঙ্গে কাজ করতে পারবে এবং নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলবে, সবকিছু বিবেচনা করে প্রমোশন হওয়া উচিত।’ এটিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত, যে কর্মকর্তা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাকে সেই বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সেই নির্দেশনা দিলেন। পদ ফাঁকা থাকলেই পদায়ন না করে যার যে বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ রয়েছে, তাকে সেই জায়গায় পদায়ন করারও নির্দেশনা দেন তিনি। স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সর্বক্ষেত্রে এই ডিজিটাল সুবিধা ব্যবহার করতে হবে। এর মাধ্যমে আমি মনে করি স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত হতে পারে।’ এটি সত্য, একটা সময় বাংলাদেশে দরপত্র বাক্স ছিনতাই হতো উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে কারণে আমরা ই-টেন্ডারে চলে গেলাম। এখন আর টেন্ডার বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা শোনা যায় না।’ এভাবেই আমি মনে করি, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি অনেকটা নিশ্চিত করা যায়। আমরা সেটাও করব’ যোগ করেন তিনি।

‘জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী সরকার’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকার গঠনের পর থেকে সবগুলো মন্ত্রণালয় সরেজমিনে দেখার চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রী তার তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনকে দেশের জন্য সেবা করার একটা বড় সুযোগ উল্লেখ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রিত্বের পদটি এখানে বড় কথা নয়, মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেটাই বড় কথা।

সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নামকরণ করেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি এ জন্য নামটি পরিবর্তন করে দিয়েছিলাম। কেননা জনগণের সেবা করা যে, এই মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, এখান থেকেই সেবাটা মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। সেটা সব সময় সবাই যেন মনে রাখতে পারেন।’ গত অর্থবছরে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮৬ ভাগে উন্নীত হয়েছে এবং আগামী ৫ বছরে এই প্রবৃদ্ধি তার সরকার ১০ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশের সাধারণ মানুষের কাছে অর্থনৈতিক সুফলটা পৌঁছে দেওয়া এবং সেজন্য আমরা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বাস্তবমুখী অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি সেটা যদি আমরা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে সেই লক্ষ্য আমরা অবশ্যই অর্জন করতে পারব।’ ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ ভিশনটা বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যাশা থাকবে জনপ্রশানের প্রতি জন-আস্থা বৃদ্ধিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিবেদিত হয়ে কাজ করবেন। তাহলে জনগণের কল্যাণ বয়ে আনবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close