ডা. এস এ মালেক

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

মতামত

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও এর গুরুত্ব

একচ্ছত্রভাবে বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আবার সংসদ ও সরকার গঠন করেছেন। নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম মন্ত্রিসভার কর্মকান্ড থেকে বোঝা যায় অতীতে যে উন্নয়ন তৎপরতা শুরু হয়েছিল, যা দেশকে একটা বিশেষ পর্যায় পৌঁছে দিয়েছে, তাকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ায় সরকার তার আশু করণীয় মনে করছে। প্রথমেই বলতে হয়, মন্ত্রিসভায় এমন কিছু নতুন মুখ স্থান পেয়েছেন, যারা সুদীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অধিকারী, তাদের পূর্বসূরিরা যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, একই আদর্শে তারা বিশ্বাসী। দু-একজন ছাড়া রাজনীতিতে তাদের নবীন বলা যাবে না। কারণ তাদের অধিকাংশের বয়স ৪০-৫০-এর কাছাকাছি। সুদীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে তারা জড়িত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের অবস্থান রয়েছে। শিক্ষাদীক্ষা, অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক আনুগত্য ইত্যাদি কারণে প্রধানমন্ত্রী তাদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন। আশা করা যায়, এবারের সরকার যে কঠিন দায়িত্ব পালন করতে অগ্রসরমান মনে হচ্ছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীকে তারা সঠিকভাবে সহযোগিতা করার যোগ্যতা রাখেন। গত ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ জাতির উদ্দেশ দেওয়া প্রধানমন্ত্রী ভাষণে যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাকে বর্তমানে জাতীয় সংকট বলে অভিহিত করা যেতে পারে। বিগত ১০ বছরে দেশকে উন্নয়নের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে দিলেও যেসব ক্ষেত্রে ঘাটতির কারণে আগামী দিনে দেশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বেশ কিছুটা দুরুহ বলে মনে হয়, তার প্রতিটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আলোকপাত করেছেন। এ সরকার গঠিত হওয়ার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে দুর্নীতি সমূলে নির্মূলে যে তৎপরতা শুরু হয়েছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তা নির্ভয়ে, বাধাগ্রস্তহীনভাবে অনুসরণ করতে পারলে, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে যে বিশেষ অগ্রগতি অর্জিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেয়। সৎ, সাহসী ও নিবেদিত প্রধানমন্ত্রী চান উন্নয়নের অগ্রযাত্রা যেন দুর্নীতির কারণে ব্যাহত না হয়। অতীতের অভিজ্ঞতা যে বাঞ্ছনীয়, তা ভালো করে জেনেশুনে প্রধানমন্ত্রী এবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছেন। এ কথা ঠিক শুধু প্রশাসন বা সরকারিভাবে তৎপরতার মাধ্যমে দুর্নীতি দূর হবে, বাস্তবতাটা এমন নয়। পৃথিবীর সব দেশেই দুর্নীতি রয়েছে। এটা সমূলে উচ্ছেদ করতে হলে যেসব আর্থসামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হয়, তা সময়সাপেক্ষ। তবে যাত্রাটা যদি শুরু হয়, তা হলে মানুষ আশার আলো দেখতে পাবে। একমাত্র দুর্নীতি রুখতে পারলে ২০-২৫ শতাংশ উন্নয়ন কার্যক্রম বেশি হতো। দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতীয় সংকট হচ্ছে মাদক ব্যবসা ও মাদকাসক্ত। এ ক্ষেত্রেও মাদকের মূল ঘাঁটি কক্সবাজার এলাকায় সরকার যে তৎপরতা শুরু করেছে, তা প্রশংসনীয়। প্রায় ২০০ মাদক ব্যবসায়ী আত্মসর্ম্পণে রাজি হয়েছেন। সরকার মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের পুনর্বাসন করবেন। একদিকে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও অন্যদিকে পুনর্বাসন কার্যক্রম নিশ্চয়ই অবস্থার উন্নতি হবে। মাদক যে কীভাবে আমাদের দেশ মার্তৃকার ওপর আঘাত হানছে, তা সর্বজনবিদিত। দেশের মাদক অর্থনীতি প্রবর্তিত হওয়ার কারণে সামাজিক ক্ষেত্রে যে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে, এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে একদিকে অর্থনীতি বিপদসংকুল হবে, অপরদিকে জাতি হিসেবে দর্শনভিত্তিক প্রাণশক্তি নিয়ে টিকে থাকব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

তবে বলতেই হবে সরকারি তৎপরতা যতই হোক না কেন, সর্বক্ষেত্রে সামাজিক উদ্যোগ ছাড়া এ কঠিন কাজ সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য স্পষ্টতই বলেছেন, আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ভিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, এমন উন্নয়ন তৎপরতা নয়, যা গণতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন; মুষ্টিমেয় নয়, সামগ্রিক কল্যাণ সাধন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সুশাসন নিশ্চিতকরণ, ৫ বছরে প্রায় দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এর সবকিছুই প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন। প্রায় ১৫ বছর দেশ শাসন করে জাতির জনকের কন্যা হিসেবে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তার আলোকেই তিনি বলেছেন। সর্বদিকে প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন এ ভাষণে দেশ এবং জাতিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। পরিকল্পিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা অবশ্যই প্রত্যাশিত সফলতা অর্জন করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিরোধী দলের নির্বাচিত এমপি সংখ্যায় যাই হোক না কেন, সংসদে বিরোধী দল যাতে তাদের ভূমিকা রাখতে পারে, সব ধরনের সহযোগিতা সব সময় তিনি দেবেন। নির্বাচনে বিরোধী দলের ভরাডুবির কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি যেসব ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল দেখা যায়। গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত প্রয়োজন বিধায় তিনি বিরোধী দলকে সংসদের ভেতরে ও বাইরে যথাযথ দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার এ আন্তরিক আহ্বানকে সাড়া না দিয়ে মূল বিরোধী দল প্রত্যাখ্যান করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা যে প্রতিহিংসামূলক ও অত্যন্ত নেতিবাচক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতির জনকের কন্যা হিসেবে, বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে, সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি বিরোধী দলকে দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠে সুসংগঠিত হয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানিয়েছেন, এটা তার নৈতিক দায়িত্ব। এটা কোনো দুর্বলতাজনিত বিষয় বা নির্বাচন অনুষ্ঠানের তথাকথিত অনিয়মতান্ত্রিকতা ঢাকার অপকৌশলও নয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশই নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ সরকারের বৈধতার কোনো প্রশ্ন উঠছে না। যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী, সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দেশের অভ্যন্তরে বিপুল ভোটে শুধু জনগণ বিজয়ী করেননি, জনসমর্থন সরকারের আছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে। গণতান্ত্রিক উপায়ে বিরোধী দলের মোকাবিলায় কোনো রূপ বাধা দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলের শোচনীয় পরাজয়ের কারণে যাতে তাদের ভূমিকা সীমিত হয়ে না পড়ে, এজন্য প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাশা করেন, সংখ্যায় কম হলেও তারা সংসদে যোগ দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র অব্যাহত রাখুক। তা ছাড়া উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রশ্নে অতীতের মতো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, এ কারণেই তিনি সার্বিকভাবে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। সবকিছু ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থ সামনে নিয়ে তিনি একদিকে যেমন বিরোধী দলকে সহযোগিতা করছেন, বিরোধী দলের উচিত সরকারকে সমর্থন দেওয়া। জাতির প্রয়োজনে ঐতিহাসিক কারণে তিনি মূল বিরোধী দলের সঙ্গে বৈঠকের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা অবশ্যই সময়োপযোগী। নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি এবং ২০৪১ সালের মধ্যে রূপকল্প বাস্তবায়ন করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার যে ঘোষণা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন, এর সফল বাস্তবায়ন করতে হলে জাতীয় ঐক্য বড় প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বড় মন নিয়ে জাতীয় ঐক্যের যে আহ্বান জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এ সুযোগ হাতছাড়া না করা। হীনম্মন্যতায় না ভুগে উদার মন নিয়ে এগিয়ে এলে বরং দেশের কল্যাণ হবে। বিরোধী দলের অনুভব করা উচিত, অতীতে তারা যে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম করেছেন, এর প্রবর্তন করলে জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করবে। যদি তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হন, এ সংসদের আকার ও প্রকৃতি যাই হোক না কেন, তাদের সংসদে যোগ দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কোনো সংকট নেই। এটা সঠিক নয়। সংকট আছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সেই সংকট মোকাবিলা করতে হলে হঠকারিতা বা সন্ত্রাসের মাধ্যমে তা অর্জন সম্ভব নয়। নির্বাচনে যদি কিছু অনিয়ম হয়েও থাকে, বিরোধী দলের উচিত প্রতিনিধিত্ব সংসদে যোগ দেওয়া। সংখ্যা বিবেচ্য নয়, গুণগত মান বজায় রেখে তারা এ সংসদকে প্রাণবন্ত ও সফল করতে পারেন, যদি তারা দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হন। জাতির উদ্দেশ তার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী যে আবেদন জানিয়েছেন, তাতে সাড়া দিয়ে সংসদে যোগদান ও সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখা অপরিহার্য বিষয় বলে দেশের সচেতন মহল মনে করে। এ কথার অর্থ এই নয় যে, রাজপথের আন্দোলন চিরতরে বন্ধ হোক। সংসদের ভেতরে ও বাইরে এবং রাজপথে বিরোধী দল ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেÑ এটা জনগণের বিশ্বাস। প্রধানমন্ত্রীর বৃহৎ আবেদন যেন ব্যর্থ না হয়। গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকা অবিস্মরণীয় ও সহায়ক। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের কল্যাণে রাজনীতি করা দরকার। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close