মীর আবদুল আলীম

  ২৭ জানুয়ারি, ২০১৯

মতামত

প্লিজ বিষ খাওয়াবেন না

আমাদের বাঁচতে দিন। কারো কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে, ক্যানসারের কিংবা অন্য কোনো জটিল রোগে ভোগছেন স্বজনরা। নিজেও সুস্থ নই। ক্যানসারে মারা গেছেন চাচা। বাড়ির পাশের শিশুটাও জটিল রোগে আক্রান্ত। রোগবালাই পেয়ে বসেছে আমাদের। মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। বিষ খেলে মানুষ তো মরবেই। বেঁচে থাকার তাগিদেই প্রতিদিনই আমরা খাবার খাই। কিন্তু এই খাবারই যে আবার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে, সে খেয়াল কজনে রাখেন। আমরা আসলে কী খাচ্ছি? কখনো কি জানতে চেয়েছি? ২৩ জানুয়ারির দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ‘হাঁস-মুরগি মাছে বিষাক্ত পদার্থ’। প্রতিবেদক ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল খায়ের। তার কাছে এ বিষয়ে জনলাম অনেক কিছু। দেশে উৎপাদিত হাঁস, মুরগি ও মাছের শরীরে মিলেছে হেভিমেটাল (এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ)। যা হাঁস, মুরগি ও মাছের শরীরে প্রবেশ করছে খাদ্যের মাধ্যমে। বিভিন্ন ধাতু ও রাসায়নিকসমৃদ্ধ বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য খাবার হিসেবে অধিক মুনাফার জন্য ব্যবহার করছেন খামারিরা। এ ধরনের মাছ ও মাংস গ্রহণ করলে তা মানবশরীরে প্রবেশ করে। তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, ট্যানারির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত পোলট্রি ফিডে হেভিমেটালে ক্যাডমিয়াম, লেড (সিসা), মার্কারি (পারদ) ও ক্রোমিয়ামসহ বেশ কিছু বিষাক্ত পদার্থ মিলেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্রোমিয়ামসহ এসব ধাতু ও রাসায়নিক থেকে ক্যান্সার, হৃদরোগ, আলসার, কিডনির অসুখ হতে পারে। মানবদেহে অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম প্রবেশ করলে পুরুষের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, নারীদের অকাল প্রসব, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগও হয়ে থাকে। দেশে ক্যান্সার রোগী বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো বিষাক্ত মাছ ও মাংস গ্রহণ।

‘হাঁস-মুরগি আর মাছের খাবারে ক্যানসারের উপাদান!’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন)। জনমনে আতঙ্ক তৈরি হবার মতোই সংবাদ। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। প্রতিদিন, প্রতি বেলায় মাছ-মাংস খেতে হয় আমাদের। হাঁস-মুরগির আর মাছের খাবারে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান ক্রোমিয়াম মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় আছে বলে কয়েক দিন ধরে যে সংবাদ ছাপা হচ্ছে তাতে ভয় হচ্ছে; ভীষণ ভয়! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিষাক্ত উপাদানযুক্ত খাবারে বেড়ে ওঠা মাছ-মুরগি মানুষের জন্যও ক্যানসার, কিডনি, লিভারের জটিল রোগের অন্যতম কারণ হতে পারে। অবশ্য এ বিষয়ের গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন জানিয়েছেন, ট্যানারি বর্জ্য ছাড়া অন্য যেসব উপাদান ব্যবহার করে দেশে যে পোলট্রি ফিড তৈরি হয়, তাতে ক্রোমিয়ামের উপাদান থাকার আশঙ্কা নেই। সে ক্ষেত্রে যেন গোটা পোলট্রি ফিডশিল্পের ব্যাপারে ভোক্তা ও উৎপাদকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি না হয়, তাতে সতর্ক থাকা জরুরি। অতীতে এ ধরনের আতঙ্কের কারণে আমাদের পোলট্রি শিল্প ধসের মুখোমুখি হয়েছিল। এর পুৃনরাবৃত্তি কোনোভাবে কাম্য নয়। এ ব্যাপারে দেশের গণমাধ্যমগুলোকেও বেশ সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে।

মাছ-মুরগির খাবারে ক্রোমিয়াম! যা কিনা ক্যানসার সৃষ্টি করে। এমন সংবাদে আতঙ্ক সৃষ্টিতো হবেই। ঢাকার হাজারীবাগ এলাকার বিভিন্ন কারখানায় তৈরি মাছ-মুরগির আর মাছের খাবারে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান ক্রোমিয়ামের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি প্রমাণ হওয়ার খবর উদ্বেগজনক সন্দেহ নেই। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীর কয়েকটি পোলট্রি ফিড প্রস্তুত কারখানায় অভিযান চালান। সেখানে প্রাপ্ত নমুনা তাৎক্ষণিক পরীক্ষায় মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ট্যানারি শিল্পের কাঁচামাল তথা গবাদিপশুর চামড়া, হাড়সহ অন্যান্য বিক্রয়যোগ্য উপাদানে বিপজ্জনক মাত্রায় এই উপাদানটি ব্যবহার হয়। ট্যানারি বর্জ্যে তৈরি পোলট্রি ফিডেও রয়ে যায় এই বিষাক্ত উপাদান। ফলে কেবল পোলট্রি ফিড নয়; অন্যান্য উৎপাদনেও এই বর্জ্যরে ব্যবহার এমনকি নির্বিচার নিক্ষেপ যে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। প্রাণঘাতী প্রবণতা রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

আমরা চাই, খোদ ট্যানারি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেই জোর দেওয়া হোক। পোলট্রি ফিডে ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি এই বর্জ্য যাতে পরিশোধন করা হয়, সেজন্যও চাই কড়া নজরদারি ও নিয়মিত অভিযান। ফার্মের মুরগির খাবার হলো দানাদার। যার সঙ্গে মিশ্রিত থাকে নানা রকম রাসায়নিক। যার কারণে এসব খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি বড় হয় ফার্মের মোরগ, ওজনও বাড়ে। এসব খাবারে লুকিয়ে আছে মরণঘাতী ব্যাকটেরিয়াসহ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর মারাত্মক জীবাণু। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ নয়। বাজারে বিক্রি হওয়া হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য (পোলট্রি-ফিশ ফিড) খাওয়ানো মুরগি কেটে এর রক্ত, মাংস, হাড়, কলিজা, মগজ ও চামড়া আলাদাভাবে পরীক্ষা করে আঁতকে উঠেছেন গবেষকরা। প্রথম দফায় এক মাস এসব খাদ্য খাওয়ানোর পরে এবং দ্বিতীয় দফায় আরেক মাস খাদ্য খাওয়ানোর পরে পরীক্ষা করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। এসব মুরগির মাথার মগজে সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্রোমিয়াম পাওয়া যায়। ক্রোমিয়াম হলো এক ধরনের ভারী ধাতু, মানবদেহে যার সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হলো প্রতিদিন ২৫ পিপিএম বা মাইক্রোগ্রাম। এর বেশি হলে বেশিটুকু শরীরে জমা হতে থাকবে এবং একপর্যায়ে প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু পরীক্ষায় এক মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে পাওয়া যায় ৭৯৯ পিপিএম এবং দুই মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে (প্রতি কেজিতে) পাওয়া যায় ৪ হাজার ৫৬১ পিপিএম। এছাড়া মাংসে যথাক্রমে ২৪৪ ও ৩৪৪, চামড়ায় ৫৫৭ ও ৩২৮, হাড়ে ১ হাজার ১১ ও ১ হাজার ৯৯০, কলিজা বা লিভারে ৫৭০ ও ৬১১ এবং রক্তে ৭১৮ ও ৭৯২ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই মাত্রা মানবদেহের জন্য অসহনীয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন বিপজ্জনক মাত্রার ক্রোমিয়ামযুক্ত মাছ বা মুরগির মাংস কিংবা ডিম খেয়ে দেশের মানুষের পুষ্টি জোগানোর ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছি, যাকে এক ধরনের ‘বিষাক্ত পুষ্টি’ বলা যায়।

বাংলাদেশে আগে হাঁস-মুরগি-মাছ বড় হতো প্রাকৃতিকভাবে। ভাত, ধানের কুঁড়া ও ভুসি খাওয়ানো হতো। আর ফার্মের মুরগি বা মাছের খাবার হলো দানাদার। যার সঙ্গে মিশ্রিত থাকে নানা রকম রাসায়নিক। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হেভিমেটাল। যার কারণে এসব খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি বড় হয় ফার্মের মুরগি, ওজনও বাড়ে। এসব খাবারে লুকিয়ে আছে মরণঘাতী ব্যাকটেরিয়াসহ মানুষের শরীরের জন্য

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে দেড় লক্ষাধিক মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং লক্ষাধিক রোগী কার্যত বিনা চিকিৎসায়ই মারা যান। দেশে ক্যানসার চিকিৎসার ব্যবস্থা ও সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। ১৫ লক্ষাধিক ক্যানসার রোগীর জন্য হাসপাতালের বেড রয়েছে মাত্র ৫ শতাধিক। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। ক্যানসার, কিডনি ও লিভার রোগের চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধি, উন্নত প্রযুক্তি ও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তবে পানি, বায়ু, মাটি ও পরিবেশ দূষণের ফলে জনস্বাস্থ্যে যে হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ না থাকলে শুধু চিকিৎসাসেবা বাড়িয়ে অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। কল-কারাখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার এবং পোলট্র্রি ফিড ও খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল ও মাননিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্যানসার, কিডনি, লিভারসহ যাবতীয় জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে বাজারে থাকা সব পোলট্রি ফিডই বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য ব্যবহার করে না। মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়ামযুক্ত, মানহীন স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে এমন পোলট্রি ফিড কারখানাগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি পোলট্রি ফিড যেন আমদানিনির্ভর না হয়ে পড়ে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ক্যানসার রোগের অন্যতম বীজাণু ক্রোমিয়াম মিশ্রিত খাবারেই আমাদের চারপাশে প্রতিপালিত হচ্ছে মানুষের খাদ্য তালিকার অন্যতম মাছ এবং মুরগি। বলা বাহুল্য, আমরা প্রতিদিন যেসব খাদ্য গ্রহণ করছি তার বেশির ভাগই বিষাক্ত কেমিক্যাল যুক্ত। বিভিন্ন মাধ্যমেই এটি প্রমাণিত। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানেও খাদ্যে ভেজালের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে। দেশে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে কাজ করে বিএসটিআই। কিন্তু উল্লিখিত বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে! এছাড়া সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোয় স্বাস্থ্য পরিদর্শক এবং পাবলিক অ্যানালিস্টরা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, ভেজাল নিরোধ করতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতিটি জেলায় খাদ্য আদালত গঠনের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে হাইকোর্টের। এ ক্ষেত্রে দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে নির্ভেজাল খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে জেলায় জেলায় একটি খাদ্য আদালত গঠন করতে হবে। উপজেলা প্রশাসনকেও এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি খাদ্য আদালত গঠনের কাজটি যত দ্রুত সম্ভব করা উচিত। সরকার জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close