সোলায়মান মোহাম্মদ

  ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

শোবিজ তারকাদের রাজনীতি

সকল নীতির রাজাই হলো রাজনীতি। নীতি-নৈতিকতা যেখানে পিছিয়ে, ঠিক সেখানেই রাজনীতির সরব উপস্থিতি থাকার কথা। অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সমাজের সব পর্যায়ের অপরাধ ও অন্যায়কে শিকড়সহ উপড়ে ফেলাই রাজনীতির মৌলিক কার্যকলাপ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রই দেখছি। আমাদের অঞ্চলে রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ঘিরে ইংরেজি ও বাংলার মিশ্রণে একটি কথার বেশ জনশ্রুতি রয়েছে আর তা হলো ‘মুখে মধু অন্তরে বিষ এরই নাম পলিট্রিকস’। যদিও সব রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য নয়। যাক সেসব কথা। রাজনীতি কেমন বা এর বর্তমান কী অবস্থা, তা আমার বলে-কইয়ে কাউকে বোঝাতে হবে না।

সবেমাত্র একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে। টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে আ.লীগ সরকার। সংসদ নির্বাচনের আলোচনা-পর্যালোচনা ও পক্ষে-বিপক্ষে সাফাই গাওয়া এবং সরকার দলের বিরোধী পক্ষের অভিযোগ এখনো শেষ হয়নি। এমতাবস্থায় নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেল সংরক্ষিত আসনের মনোনয়নপত্র ক্রয় এবং জমাদান নিয়ে। সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পেতে চারদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম ক্রয়ে হিড়িক পড়ে গেছে। রাজনৈতিক কর্মীসহ বিভিন্ন অঙ্গনের নারী নেত্রীদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমের মূল্য ধরা হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশের ৩৫০টি আসনের মধ্যে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত। এবারের নির্বাচনে ২৯৯টি আসনে সরাসরি ভোট হলেও সংরক্ষিত আসন বণ্টন হয় ভোটে জয়ী দলগুলোর আসন সংখ্যার অনুপাতে। সে হিসেবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে এবার আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত আসনে ৪৩টি, জাতীয় পার্টি চারটি, বিএনপি একটি, স্বতন্ত্র ও অন্যরা দুটি পেতে পারে। যেখানে ৫০টি আসনের ৪৩টিই আওয়ামী লীগ পাওয়ার কথা, সেখানে তো ভিড় হবেই। অনেক নারী নেত্রী এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হতে দলীয় মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। দলীয় হাইকমান্ডের দরজায় দরজায় নক করছেন। রাজনৈতিক সূত্র ধরে বাবা কিংবা মৃত স্বামী বা ভাইয়ের রাজতৈনিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে দলীয় সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছেন। দীর্ঘদিন ধরে যারা আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা মনোনয়ন ফরম কিনবেন, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু হঠাৎ করেই যখন রাজনীতির মাঠে কোনো ব্যক্তি কোমর বেঁধে নেমে পড়ে, তখন তো একটু খটকা লাগবেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যাদের সারা জীবন আওয়ামী লীগের ধারের কাছেও ঘেষতে দেখা যায়নি, তারাও এবার মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে যে বিষয়টি তা হলো শোবিজ অঙ্গনের তারকাদের মনোনয়নপত্র ক্রয়ের দৌড়ঝাঁপ। হালের নায়িকা থেকে শুরু করে কয়েক যুগ আগের নায়িকারাও পিছিয়ে নেই। নায়িকাদের এমন এমপি হওয়ার প্রতিযোগিতাকে সাধারণ মানুষ খুব যে ভালোভাবে নিচ্ছে, তা কিন্তু নয়। যদিও সাংবিধানিক দিক থেকে কোনো বাধানিষেধ নেই। সব জায়গায় নায়ক-নায়িকাদের উপস্থিতি আনন্দের বাতাস বয়ে আনলেও এবারের সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নপত্র ক্রয় ও জমাদানের ক্ষেত্রে কিন্তু তার উল্টোটিই ঘটেছে। রাজনৈতিক মহলের নারী নেত্রীদের কাছে বিষয়টি বিষের মতোই লেগেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যার প্রমাণও পাওয়া গেছে। সাবিনা আক্তার তুহিন, আওয়ামী লীগের নারী নেত্রী, দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দুঃসময়ে রাজপথে থেকে কঠোর ভূমিকাও পালন করেছেন এবং কারাবাসের শিকারও হয়েছেন বহুবার। তিনি তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রাজনীতি থেকে মনে হয় বিদায় নিতে হবে, নায়ক-নায়িকাদের এত ভিড়ে আমাদের আর দেখা পাওয়া কঠিন। আন্দোলন-সংগ্রামের রোদে পোড়া শরীর এখন কিছুটা ভালো দেখতে হলেও নায়িকাদের রূপে বিলীন।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন মহাবিপদ, আমাদের দল ছিনতাই করেছে নায়িকা হাইব্রিড বিএনপি থেকে আমদানিকারীরা।’ সুতরাং বিষয়টি সহজেই অনুমেয় যারা দীর্ঘদিন ধরে রোদে পোড়ে দলের সাংগঠনিক কাজ করেছেন এবার যখন ক্ষমতার একটু ছায়ায় আশ্রয় নীতে চাচ্ছেন; ঠিক তখন হঠাৎ করে আসা হাইব্রিড নেত্রীদের আক্রমণ। অভিনয় ছেড়ে রাজনীতি নিয়ে টানাটানি। কেউ কেউ বলছেন, এটা তাদের সেলিব্রিটি রোগ। নায়িকাদের সংসদ সদস্য হওয়ার ইচ্ছা উদয় হওয়ার পেছনে অবশ্য তাদের একটি খোঁড়া যুক্তিও আছে। তারা মানুষের সেবা করতে চান। মনে হচ্ছে, সংসদ সদস্য হওয়া ছাড়া আর জনগণের সেবা করা যায় না। তাই তারা পণ করেছেন সংসদে গিয়েই জনগণের সেবা করবেন। কিন্তু এখানে বলতে হয়, যদি জনগণের সেবা করার এতই আগ্রহ, তাহলে আগে তারা ছিলেন কোথায়? মাঠপর্যায়ের রাজনীতি বা সেবামূলক কোনো কাজে তো কখনো তাদের ওইভাবে চোখে পড়েনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তো তাদের দু-একজন ছাড়া বাকিদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আসলে মোট কথা হলো, এত দিন তারা পর্দায় অভিনয় করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন, তাই এখন সরাসরি বাস্তবে অভিনয় করতে চান। তবে দু-একজন ব্যতিক্রমও থাকতে পারেন। সে যাই হোক শোবিজ অঙ্গনের তারকাদের ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ৯ জন মনোনয়ন ফরম ক্রয় করেছেন। তৃতীয় লিঙ্গের এরাও মানুষ, তাদেরও স্বাদ আহ্লাদ আছে রাজনীতি করার। যদিও সংবিধানে তাদের সংসদে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে কি না, সেটা খুঁজে দেখতে হবে।

পরিশেষে রাজনীতি অনেকের কাছে ক্ষমতার অপব্যবহার করার মূল চাবিকাঠি। আবার অনেকের কাছে জনসেবারও একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম। সুতরাং আশা করি, ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই সংরক্ষিত আসনের এ মহান দায়িত্বভার বণ্টন করবেন। আমরা চাই কেবলমাত্র সৎ ও যোগ্যরাই এ আসন গ্রহণ করুক।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close