নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯

আলোচনা

কৃষকের লাভ-ক্ষতি ও খাদ্য নিরাপত্তা

ধান-চালের দাম, কৃষকের লাভ-ক্ষতি এবং টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়গুলো এক অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নির্বাচনের পর চালের দাম কেজিপ্রতি এক-দুই টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানের হাটবাজারে আমন ধানের দাম সামান্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে অসহায় কৃষকের মুখে সামান্য স্বস্তির আভা দেখা দেয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে একশ্রেণির সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে ত্রিশাল ভাটিপাড়ার এক ভুক্তভোগী কৃষক মো. আবু তাহের আক্ষেপ করে বলেন, চালের দাম একটু বাড়লেই সংবাদমাধ্যমে হইচই শুরু হয়ে যায়, কিন্তু কৃষক যখন তার উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করে উৎপাদন খরচটাও তুলতে পারেন না, তখন কথা বলার কেই থাকে না।

বাংলাদেশে সবার সংগঠন আছে। সংগঠনের মাধ্যমে তারা সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারেন। দাবিদাওয়া আদায় করতে পারেন। কিন্তু কৃষকের কোনো সংগঠন নেই। নেই কোনো রাজনৈতিক দল। ফলে কৃষকের কথা কেউ শোনেন না। এ বছর আমন মৌসুমে তিনি ২ দশমিক ৭৩ একর জমিতে বিভিন্ন হাইব্রিড ও ইনব্রিড জাতের ধান চাষ করেন। হাইব্রিড জাতগুলোর মধ্যে ছিল তেজিগোল্ড ও ধানিগোল্ড এবং ইনব্রিড জাতগুলোর মধ্যে ছিল ব্রিধান ৩২ ও ব্রিধান ৫২। তার ওই পরিমাণ জমি থেকে ১০০ মণ ধান উৎপাদিত হয়। ধান উৎপাদনে জমি চাষ, চারা রোপণ, পরিচর্যা, সার, বীজ, কীটনাশক, কাটা ও মাড়াই বাবদ ৪৩ হাজার টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া রয়েছে তার নিজের পরিশ্রম ও জমি ভাড়ার খরচ। মৌসুমের শুরুতে বাজারে আমন ধানের দাম ছিল ৬০০ টাকা মণ। এ দামে ধান বিক্রি করে তার আসল টাকাও ওঠে না। এ বিবেচনায় তিনি ওই সময় ধান বিক্রি না করে বাড়িতে সংরক্ষণ করে রেখে দেন। আবু তাহের তার ২ দশমিক ৭৩ একর জমিতে উৎপাদিত খড়ের সামান্য অংশ বিক্রি করে ১৭ হাজার টাকা আয় করেন এবং বাকি খড় বিক্রি করে আরো ২৩ হাজার টাকা পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি এ বছর এক মৌসুমে ধান চাষের জন্য প্রতি বিঘা জমি লিজ দিয়েছেন ৪ হাজার টাকা করে। সে হিসাব তার ২ দশমিক ৭৩ একর জমির লিজ মানির পরিমাণ হলো ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা। উৎপাদন খরচের সঙ্গে লিজ মানি যোগ করলে ১০০ মণ ধানের মোট উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ৭৬ হাজার ৬০০ টাকা। ৬০০ টাকা মণ দরে ১০০ মণ ধানের দাম ৬০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২ দশমিক ৭৩ একর জমিতে আমন ধান চাষ করে তার লোকসান হচ্ছে ১৭ হাজার ৬০০ টাকা। খড়ের দাম বিবেচনা করলে তার ২ দশমিক ৭৩ একর জমি থেকে ধান ও খড় বিক্রি করে মোট আয় ১ লাখ টাকা এবং খরচ ৭৬ হাজার ৬০০ টাকা। নিট লাভ ২৩ হাজার ৪০০ টাকা। ওই কৃষকের মতে, প্রতি মণ আমন ধানের ন্যূনতম দাম হওয়া উচিত ৮০০ টাকা। সম্প্রতি ত্রিশালসহ ময়মনসিংহের বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতি মণ ব্রিধান ৪৯ বিক্রি হচ্ছে ৭৬০ টাকা দরে এবং কিরণমালা জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকা দরে। ত্রিশাল উপজেলার পাঁচপাড়া গ্রামের ধান চাষি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে তার কিরণমালা জাতের ধান ফলেছে ১৫ মণ। বিঘাপ্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা এবং ধান বিক্রি করে আয় হয়েছে ৯ হাজার ৭৫০ টাকা। সে হিসাবে প্রতি বিঘা জমিতে ধান চাষ করে লোকসান হয়েছে ২৫০ টাকা।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর পত্র-পত্রিকায় চালের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হলে ত্রিশালের পাইকারি ও খুচরা চাল বাজারের খরব নিয়ে জানা যায়, নির্বাচনের পর চালের দাম তেমন বাড়েনি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালে দাম এক-দেড় টাকা বাড়তে পারে। কোনো কোনো চালের দাম নির্বাচনের আগের সপ্তাহের মতোই রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। ত্রিশালের বড় পাইকারি চাল ব্যবসায়ী লোকনাথ খাদ্য ভান্ডারের কর্ণধার কৃষ্ণ মোদক জানান, বর্তমানে তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি কেজি ব্রিধান ২৮ ও ব্রিধান ২৯ জাতের চাল ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা, গুটি স্বর্ণা প্রতি কেজি ৩০ এবং চিকন নাজিরশাইল ৪২-৪৩, মিনিকেট ৪৬-৪৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও এসব চাল প্রায় একই দামে বিক্রি হয়েছে। নির্বাচনের পর চালের দাম বাড়েনি। খুচরা ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন, বিপ্লব ও সুমন জানান, বর্তমানে তাদের দোকানে প্রতি কেজি ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ২৯ ও ব্রিধান ৪৯ জাতের চাল ৩৮-৪০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের তুলনায় এ দাম কেজিপ্রতি ১ থেকে ২ টাকা বেশি। চালকল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে ৪০ কেজি আমন ধান থেকে ২৬ কেজি চাল পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি কেজি চালের দাম যদি ৩৫ টাকাও হয়, তা হলে ২৬ কেজি চালের দাম দাঁড়ায় ৯১০ টাকা। এ ছাড়া রয়েছে কুড়ার দাম। প্রতি মণ ধান থেকে চাল উৎপাদন খরচ ৫০ টাকা বাদ দিলেও প্রতি মণ আমন ধানের দাম হওয়া উচিত ৮৬০ টাকা। কিন্তু কৃষক সেই দামটুকুও মিল মালিক এবং ধান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাচ্ছেন না। সরকার এ বছর প্রতি কেজি আমনের দাম নির্ধারণ করেছে ৩৬ টাকা। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান না কিনে চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করছে। এতে লাভবান হচ্ছেন একশ্রেণির মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ী। কৃষকের কোনো লাভই হচ্ছে না। তারা ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতেও হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে তাদের মধ্যে ধান উৎপাদন ও ফলন বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনো প্রকার উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার নওগাঁর ধামইরহাট ও পোরশা উপজেলার দুটি খাদ্যগুদাম পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি আর পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ধান ও গম কেনার সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। দেশে খাদ্যগুদামের মোট ধারণক্ষমতা ২১ লাখ টন। এর সিংহভাগে খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। উৎপাদিত শস্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে আগামীতে কৃষকের কাছ থেকে ধান ও গম কেনা হবে। তবে তার আগে গুদামের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ও গম কেনা ছাড়া শস্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, খাদ্যশস্য সংগ্রহের সময় ওজন ও গুণগত মানের বিষয়ে খাদ্য বিভাগের অবস্থান জিরো টলারেন্স। কোথাও কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়র দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, রাজধানীর বাজারে সপ্তাহ ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২ টাকা। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজরদর পর্যবেক্ষণ সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবমতে, গত এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। আর দেশের চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির মতে, দেশের কোনো মিলে চালের দাম বাড়েনি।

এখন সারা দেশে চলছে বোরো ধান রোপণের মহোৎসব। কৃষক জমি চাষ, জমি তৈরি, চারা তোলা, চারা রোপণ প্রভৃতি কাজে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। ধান রোপণের এই ভরা মৌসুমে তিন বেলা খাবারসহ কৃষি শ্রমিককে দৈনিক মজুরি দিতে হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। একজন শ্রমিক সারা দিনে বড়জোর ১০ শতক জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে পারেন। সে হিসাব প্রতি একর জমিতে ধানের চারা রোপণে কৃষককে খরচ করতে হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। আর যারা রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার করছেন তাদের খরচ হচ্ছে অনেক কম। জানা যায়, রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণে একরপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা সাশ্রয় হয়। এতে প্রতি একর জমিতে চারা রোপণে সময় লাগে মাত্র দেড় ঘণ্টা। এ ছাড়া চারার বয়স কম থাকার কারণে ফলন বেশি হয়। চারা কম লাগে। সমদূরত্বে সমসংখ্যক চারা রোপণের ফলে ধানগাছ সমভাবে আলো-বাতাস পায়, ফলে রোগ ও পোকার আক্রমণও হয় কম।

তাই ধানে উৎপাদন খরচ কমিয়ে, ফলন বাড়িয়ে ধান চাষকে লাভজনক করতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নেই ধান চাষের আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি ও গুণগত মানের উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে ধান চাষি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বিএডিসি ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। মাঠপর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি, চাষি যোগাযোগ, উঠান বৈঠক, কৃষক প্রশিক্ষণ, পদ্ধতি প্রদর্শনী, ফলাফল প্রদর্শনী সভা, মাঠদিবস উদযাপনসহ সম্প্রসারণ কর্মকা আরো জোরদার ও গতিশীল করতে হবে।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লি., নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close