হাসান জাবির

  ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

নতুন স্নায়ুযুদ্ধের কবলে বিশ্ব

১৯৩৩ সালের নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এ ঘটনা সোভিয়েত বিপ্লব উত্তর বিশ্ব পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন আনে। এ পর্যায়ে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হলে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় আমেরিকা ও রাশিয়া। কিন্তু যুদ্ধ শেষে বিজয়ী মিত্রশক্তির মধ্যে শুরু হয় ভূ-রাজনৈতিক আধিপ্যু বিস্তারের লড়াই। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়ার পুঁজিবাদী ব্লকের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও তাদের মিত্রদের মধ্যকার দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয় ১৯৯০ সালে। এ সময় সোভিয়েত ব্যবস্থার বিপর্যয় সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের আনুষ্ঠানিক ঐক্যের অবসান ঘটায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব নতুন পুঁজিবাদী বিশ্ব কাঠামোর নেতৃত্বের আসনে বসে। এ ঘটনায় মার্কিন উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। তখন একজন মার্কিন কূটনীতিক ফ্রাসিস ফুকুয়ামা ‘দি অ্যান্ড ওফ হিস্ট্রি’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমরা মানবজাতির মতাদর্শগত ক্রমবিকাশের সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। যেখানে পশ্চিমা উদারবাদী গণতন্ত্রের সার্বজনীনতা নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

এ ঘটনার পর থেকেই সোভিয়েত উত্তরসূরি রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাশিয়া বিশ্বে নিজের পূর্বতন প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। সাবেক রুশ মিত্ররা ক্রমেই সংযুক্ত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের আওতায়। এক বিরুদ্ধ প্রেক্ষাপটে রাশিয়া তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাটোর সঙ্গে নানা ধরনের মৈত্রী স্থাপন করে। কিন্তু ২০০০ সালে ঘুরে দাঁড়ায় দেশটি। এ সময় রাশিয়া ঘোষিত নতুন ‘পররাষ্ট্র ও সামরিক নীতি’ বিশ্ব মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। যার মধ্যে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের বীজ দেখেন কেউ কেউ। সংগত কারণেই রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। এর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক অবনমন করে মস্কো। এতদসত্ত্বেও ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপ অভিমুখী আগ্রাসী সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকে। রুশ উদ্বিগ্নতা উপেক্ষা করেই রুশ জাতীয় সীমানা বরাবর শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে ন্যাটো। তখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ‘জাতীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ স্থাপন নিয়ে রুশ-মার্কিন সম্পর্কে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে একপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে মস্কো ও বেইজিং সমন্বিত উদ্যোগ নিতে মতৈক্যে পৌঁছে। অবশ্য এর আগে ১৯৯৩ সালেই নিজেদের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি সম্পাদিত করে রাশিয়া-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি ঘটায়; যা রাশিয়া ঘোষিত নতুন বিশ্ব প্যাটার্ন-এর ধারণাকে মজবুত করে। চীন-রাশিয়ার এ ঘনিষ্ঠতাই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। অন্যদিকে ইউরোপের সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক জ্বালানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাশিয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। ওই আলোকেই ফ্রান্স কর্তৃক রাশিয়ায় একটি অপ্রচলিত সামরিক সরবরাহ চুক্তি সম্পাদিত হলে নড়েচড়ে বসে পশ্চিমা বিশ্ব।

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের ভেতর দিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রের ব্যাপক উৎকর্ষতা লাভ, একই সঙ্গে একচ্ছত্র পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতিবিষয়ক তৎকালীন সব ধারণার বিপরীতে আলাদা একটি ব্যবস্থার উন্মেষ ঘটে। ওই ঘটনার মধ্যেই সুপ্ত ছিল মতাদর্শিক বিরোধ, যা প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পুন ও বিভক্তি, ব্রিটেনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন একই সঙ্গে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ইত্যাদি ঘটনার প্রতিক্রিয়া স্নায়ুযুদ্ধকে বেগবান করেছিল। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট!

গত দেড় দশকে বিশ্বরাজনীতিতে বিভিন্ন রূপান্তর সম্পন্ন হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিপরীতে নতুন একটি ধারণা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে রাশিয়া ও চীন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত এমনকি সমগ্র ইউরোপজুড়ে একটি সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতা নতুন করে সম্প্রসারিত হয়েছে। এ লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক কর্মকান্ড অগ্রগণ্যতা পেয়েছে। এ ছাড়া পাল্টাপাল্টি সামরিক তৎপরতাও বিদ্যমান ছিল বা আছে। ফলে বিশ্বে সংঘাত বৃদ্ধির পাশাপাশি অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিস্তার ঘটেছে। এর প্রতিফলন দেখা যায় স্ট্রকহোম ইন্ট্যারন্যাশনাল পিচ রিসার্চ ইনিস্টিটিউট বা সিপিরির সামরিক ব্যয় সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে। গত বছর মে মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ২০১৭ সালে মোট বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় ছিল ১৭৩৯ বিলিয়ন ডলার; যা পূর্বতন বছরগুলোর চেয়ে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সামরিক ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশই আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার। অন্যদিকে ন্যাটোর সামরিক ব্যয় ছিল বৈশ্বিক ব্যয়ের ৫২ ভাগ।

প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলেও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া পুনরুত্থান সম্পর্কে বরাবর সচেতন ছিল পশ্চিমারা। তাই দীর্ঘ বিরতির পর রাশিয়া পশ্চিমাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করলে আমেরিকাও দ্রুত পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে জাতীয় রণনীতির কেন্দ্রীয় লক্ষ্য হিসেবে এশিয়া প্যাসিফিকে নিজের নৌশক্তি বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ মার্কিন সিদ্ধান্ত চীনের সামরিক পরিকল্পনাকে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। এ পর্যায়ে চীনের সামরিক কৌশলে অগ্রাধিকার পায়Ñ এন্ট্রি এক্সেস এরিয়া ডিনায়েল সিস্টেম। এ মৌলিক সামরিক কৌশলের লক্ষ্য হচ্ছে কৌশলগত রণাঙ্গনে শত্রু সেনাদের আগমন আগেভাগেই ঠেকিয়ে দেওয়া। এ সামরিক কৌশল তাইওয়ান ও পূর্ব চীন সাগরের ভৌগোলিক বিরোধ-সংক্রান্ত মার্কিন পরিকল্পনাকে সংকুচিত করে। এতদসত্ত্বেও এশিয়া প্যাসিফিকে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির ফলে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের গতিকে বেগবান করবে নিঃসন্দেহে। এ লক্ষ্যেই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির প্রচেষ্টা চালিয়ে আমেরিকা এশিয়া প্যাসিফিকে শক্তির ভারসাম্যপূর্ণ স্থিতাবস্থা ধরে রাখতে চাইছে।

এদিকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে শক্তভাবে জড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির চেহারা আমূল পাল্টে দিয়েছে রাশিয়া। রুশ সামরিক তৎপরতায় উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যাবতীয় তৎপরতার অবসান হয়েছে। আজ এ কথা পরিষ্কার যে, নতুন স্নায়ুযুদ্ধের কেন্দ্রীয় অংশজুড়েই আছে মধ্যপ্রাচ্য। সিরিয়া ঘিরে আমেরিকা, ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধের অবস্থানে আছে রাশিয়া ও ইরান। এ সংকট সহসাই অবসান হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে রাশিয়া বনাম পশ্চিমা বিশ্ব একই সঙ্গে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার এ লড়াই শেষ পর্যন্ত কোনো দিকে যায়; সেটি বলা মুশকিল। মূলত ইউক্রেন সংকটের জেরে রুশ সীমানা বরাবর প্রতিদিন যুদ্ধের মহড়া চালাচ্ছে ন্যাটো ও রাশিয়া উভয়েই। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী সামরিক সম্পর্কে জড়িয়ে রাশিয়াকে চেপে ধরতে সক্ষম হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি উত্তরণের পরিবর্তে প্রায় প্রতিনিয়ত রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট নতুন অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। যা বিশ্বকে অত্যধিক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে একটি বৃহৎ যুদ্ধের শঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে।

নতুন স্নায়ুযুদ্ধের একটি নমুনা দেখা গেছে কয়েক মাস আগে। রুশ ডাবল এজেন্ট সের্গেই ক্রিপালের হত্যা প্রচেষ্টা-সংক্রান্ত ইঙ্গ-রুশ দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনায় পশ্চিমাদের রুশবিরোধী ঐক্য আরো একবার দেখল বিশ্ব। এ-সংক্রান্ত রুশ অবস্থানের বিরোধিতা করে একযোগে ১৫১ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে বেশ কয়েকটি দেশ। যদিও স্নায়ুযুদ্ধের আবহেই রাশিয়াও প্রত্যেকটি দেশের নির্দিষ্টসংখ্যক কূটনীতিক বহিষ্কার করে। এ ঘটনাকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের চূড়ান্ত ইঙ্গিত হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়।

মূলত ইউরোপে রুশ আগ্রাসনের পূর্বতন ভিতি নতুনরূপে ফিরে এসেছে ইউক্রেন সংকটের মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার রুশ অন্তর্ভুক্তিকে বাঁকা চোখে দেখছে পশ্চিমারা। একই সঙ্গে ইউরোপের প্রবেশপথ হিসেবেখ্যাত ভূমধ্যসাগরের সামরিক পরিস্থিতিতে রাশিয়ার কৌশলগত শক্তি বৃদ্ধির ঘটনাটিও আমলে নিতে হয়েছে আমেরিকা ও তার মিত্রদের। এ দুই ঘটনার পাশাপাশি আর বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের চলমান বিবাদ, চীন-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধ নতুন স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর নতুন স্নায়ুযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া বিশ্ব সমীকরণে কী পরিবর্তন আনেÑ সেটিই দেখার বিষয়।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close