অলোক আচার্য

  ২৪ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

প্রত্যাশার সঙ্গে রয়েছে শঙ্কা

নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে শেষ হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিশাল ব্যবধানে বিরোধী দলকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ফের দেশ পরিচালনার দায়িত্বে। জনগণের বিশাল ভোটে তারা ক্ষমতায়। বিগত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। জনগণের ভোট প্রদানের অর্থ হলো বিশ^াস করা। জনগণ আওয়ামী লীগের ওপর বিশ^াস করেছে। এ বিশ^াসের মূল্য দেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জের বিষয়। কারণ বিজয় যত বড় চ্যালেঞ্জ তত বেশি। বিগত ১০ বছরের শাসনামলের উন্নতি এবং তাদের ভাগ্যোন্নয়ন জনগণের মধ্যে এ বিশ^াসের জন্ম দিয়েছে যে, এই সরকারই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। আওয়ামী লীগের প্রথমেই নির্বাচনের আগে যে যে অঙ্গীকার করেছে, সেগুলো পূরণ করার। লিখিত অঙ্গীকার যে কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা প্রমাণ করতে হবে। অর্থনীতির অগ্রগতিসহ দেশকে ডিজিটালাইজেশন করার পেছনে আওয়ামী লীগের অবদান অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই দেশের উন্নয়নের মূলেই রয়েছে কৃষির উন্নয়ন। দেশের অসংখ্য কৃষকের জীবন ও জীবিকা কৃষির সঙ্গে জড়িত। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি ও জীবন মান উন্নত হলেও প্রান্তিক কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের জীবন। দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান যদি থাকে, তা হলো আমাদের মাঠে রোদে-পুড়ে কাজ করা কৃষকরা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। অথচ তাদের হাত ঘুরে বড় বড় ব্যবসায়ী মুনাফা ঠিকই ঘরে তোলেন। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। যেকোনো উপায়ে কৃষকদের উৎপদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। প্রান্তিক মানুষের জীবন মান উন্নত না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন আধুনিকায়ন করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের প্রণোদনা ও পরামর্শ প্রদান করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের দেশ কৃষি ও কৃষকের। তাই সবার আগে কৃষি ও কৃষকের মূল্যায়ন করতে হবে। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করবে আর বাজারে তা জলের দরে বিক্রি হবে; তাহলে কৃষকের শ্রমের অবমূল্যায়ন করা হবে। তাই ফসলের ন্যায্য পাওনা কৃষকের জন্য নিশ্চিত করতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যাপক উন্নত হলেও বেকার সমস্যা বর্তমানে আমাদের দেশে প্রকট। আইএলওর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষিত বেকারদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। যদিও গত কয়েক বছরে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বহু বেকার যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বিবিএসের গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বেকার সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো, এ বেকারের একটি বড় অংশই শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। গত বছরের অধিকাংশ সময়ই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। সরকারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বয়স বৃদ্ধির। প্রথমেই সরকারের এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। প্রতি বছর কয়েক লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া শেষ করে চাকরি খোঁজা শুরু করছেন। পরের বছর আবার নতুনরা এর সঙ্গে যোগ হচ্ছেন। কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে সরকারের চ্যালেঞ্জ হবে বেকার সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) শ্রমশক্তির জরিপে দেশে পুরোপুরি বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শতাংশের দিক থেকে ৪ দশমিক ২ ভাগ। মোট বেকারের মধ্যে মহিলা ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পুরুষ মাত্র ৩ শতাংশ। ১৫ বছরের ওপরে কর্মক্ষম মানুষ রয়েছে ১০ কোটি ৬১ লাখ। এর মধ্যে শ্রমশক্তি রয়েছে ৬ কোটি ২১ লাখ। কর্মে যুক্ত আছে ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ। বেকারের মধ্যে শিক্ষিত আর নারী বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালেও শ্রমশক্তি জরিপে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এখন জরিপ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন যদি থাকেও তাতে কী যায়-আসে। টেকনোলজি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এখানে ৪০ হাজার পদ পূরণ হবে। তাছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়েও নিয়োগ পাবে কয়েক হাজার। তবে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দিতে হবে।

গ্রামকে শহরে পরিণত করার কথা তাদের ইশতেহারে বলেছিল। গ্রামকে শহরে রূপান্তর করার অর্থ হলো শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে আসা। ক্ষমতায় থাকা মহাজোট সরকারের সময় বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র পুরোপুরি কাজ শুরু করলে এ উৎপাদন আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। একসময় যে গ্রাম অন্ধকারে ডুবে থাকত আজ সেসব গ্রামে আলো জ¦লছে। উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হলো বিদ্যুৎ। কল-কারখানা স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো পরিকল্পনা করে গড়ে তুলতে হবে। তবে সেই সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে যেন কোনোভাবেই চাষের জমি নষ্ট না হয়। আমাদের কৃষির ওপর চাপ সৃষ্টি করে কোনো উন্নয়ন ফলপ্রসূ হবে না। অর্থাৎ গ্রাম এবং শহরের মধ্যে উন্নয়নে একটি ভারসাম্য স্থাপন করতে হবে। ছোটখাটো সুবিধা পেতে গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার প্রয়োজন না হয়। তা হলে শহরমুখী চাপ কমে আসবে। সুযোগ-সুবিধার জন্যই আমাদের দেশে গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। কিন্তু সেই সুবিধাগুলো যদি গ্রামেই পাওয়া যায়, তা হলে শহরমুখী চাপ কমে আসবে। সুতরাং এ কাজটিও একটি সময়সাপেক্ষ এবং বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয়।

বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর দেশ দুর্নীতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে আমাদের দেশ দুর্নীতিতে প্রথম হওয়ার লজ্জা অর্জন করে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতি কমতে থাকে। লজ্জাজনক সে অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি কমেনি। দুর্নীতি আমাদের দেশের প্রতিটি খাতকে গ্রাস করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রতিটি মৌলিক ক্ষেত্রেই দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেছে। তাই দুর্নীতি রোধ করা সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। দুর্নীতি রোধ করতে হলে সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের আমল বা কর্মকর্তা যেই হোক না কেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ দুর্নীতি আমাদের মেধা ধ্বংসেরও কারণ। চাকরির বাজারে দুর্নীতির কারণে মেধার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, ফলে দেশ কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হচ্ছে না। ঘুষের বিনিময়ে চাকরিÑ এ নির্লজ্জ সত্যটি চিরকালের মতো মুছে দিতে হবে। মেধাবীরা তাদের যোগ্যতায় মেধার জোরে চাকরি পাবেন। এ কাজটি করতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অবস্থান ধরে রাখতে হবে। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। মহাজোট সরকারের সময়কালে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে উন্নয়নের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা জরুরি যে, এ উন্নয়ন সুষম উন্নয়ন কি না। উন্নয়ন সুষম না হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে পুঁজিবাদের থাবা থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে হবে। ব্যাংকিং খাতকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে। গত বছর ব্যাংকিং খাতে যে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের লাগাম টেনে ধরতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। কারণ এ দেশ কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর নয়। এ দেশ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের। তাই তাদের জীবন মান উন্নয়নে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন চিত্র ফুটে উঠবে।

দেশের সার্বিক জীবন মান, অবকাঠামো এবং আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন করা একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। এখানে দেশের অর্থনীতির গতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্ভাবনাময়। বিগত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান সম্পদের মধ্যে রয়েছে জনশক্তি। এ ক্ষেত্রে চীন বড় একটি উদাহরণ। বিশাল জনশক্তি নিয়েও চীন আজ অর্থনীতি, সামরিকসহ সব দিক থেকে উন্নত দেশ। ভারত তার জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলেছে। জনশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করার জন্য জনগণকে দক্ষ করে গড়ে তোলা আবশ্যক। জনগণকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রযুক্তি এবং কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। শিক্ষিত বেকারদের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। ফ্রিল্যান্সিং করেও আজ দেশের বহু যুবক-যুবতী দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। এভাবে চাকরির আশায় না ঘুরে তাদের যদি স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা যায় তা হলে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি আরো ত্বরান্বিত হবে। তবে দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। এখন দুর্নীতি রোধ করার জন্য সরকারের যেমন দায় রয়েছে; তেমনি নাগরিক হিসেবে নিজেদেরও দায় রয়েছে। কিন্তু আমরা কেউই নিজের ওপর দায় নিতে রাজি নই। কেবল ভোট দিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। একজন নাগরিক হিসেবে যে দায়িত্ব রয়েছে, তা পালন করলেই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। বাংলাদেশ একসময় বিশে^র শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে। এ দেশ অর্থনীতি এবং অবকাঠামোতে বিশে^ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close