রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৪ জানুয়ারি, ২০১৯

আন্তর্জাতিক

আধিপত্য রক্ষার প্রতিযোগিতায় পরাশক্তি

সম্প্রতি আলমনিটরে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তুরস্কের সরকারের পক্ষে এ ধারণা জন্মেছে যে, এ সংকটে আঙ্কারা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসছে। তুরস্কের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। পশ্চিমা দেশ ও রাশিয়ার মধ্যে এ স্বার্থের দ্বন্দ্বে মাঝখান থেকে বলকানের গ্যাস বাজারের কৌশলগত গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। আলবেনিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাসকল মিলো এএফপিকে জানান, পূর্ব ও পশ্চিমকে সংযুক্ত করা জ্বালানি করিডরের ক্রসরোডে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ অবস্থিত। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব আকর্ষণীয় না হলেও ইউরোপের অন্যান্য কৌশলগত বাজারের ট্রানজিট টেরিটোরি ও গ্যাস মজুদের দিক থেকে এ অঞ্চলের গুরুত্ব অনেক। এ অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে জ্বালানিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে রাশিয়া। যার সুবাদে বেশ কয়েক বছর দখলদারিত্বের এ খেলায় জয়লাভ করেছে রাশিয়া। এবার এ পথে এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। এরই মধ্যে এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প চালু করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য এ অঞ্চলের মস্কো নির্ভরশীলতা কমে আসবে। রাশিয়ার সোচিতে ১৭ সেপ্টেম্বর রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে সিরিয়া নিয়ে বিশেষ করে ইদলিব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। দুই নেতা ঐকমত্যে পৌঁছেন।

কিন্তু তাদের সমঝোতার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর সিরিয়ার লাতাকিয়ায় হামলা চালায় ফ্রান্স ও ইসরায়েল। ওই অভিযানে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে একটি রুশ যুদ্ধবিমান ভূপতিত হয় আর বিশ্ব এগিয়ে যায় পরমাণুযুদ্ধের দিকে। এরদোয়ান ও পুতিন ইদলিবের ব্যাপারে যে ঐকমত্যে পৌঁছেন, সে ব্যাপারে রুশ সংবাদমাধ্যম আরটি জানায়, ইদলিবে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার চওড়া বেসামরিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করা হবে; কোন জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে, তা নির্দিষ্ট করা হবে। ইদলিব সীমান্তে তুর্কি ও রুশ বাহিনীর যৌথ টহলের ব্যবস্থা করা হবে এবং হামা, দামেস্ক ও আলেপ্পোর মধ্যকার প্রধান সড়ক খুলে দেওয়া হবে। এরদোয়ান-পুতিন আলোচনার অনেক দিক ছিল। এসবের একটি হলোÑ ইদলিব ইস্যুতে পশ্চিমাদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে উভয় পক্ষের উদ্বেগ। তুরস্ক এবং রাশিয়া এখন তাদের কৌশলগত সম্পর্ককে আরো জোরদার করছে। ভবিষ্যতে তাদের এ সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্ক রাশিয়ান এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করার মাধ্যমে উভয় দেশের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্কের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী এপ্রিলে আক্কু ইউ পরমাণু শক্তি প্লান্ট প্রকল্প শুরু করা এবং টার্কস্টিম প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনের অগ্রগতি উপলক্ষে সম্প্রতি যে গ্রাউন্ড ব্রেকিং অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তাতেই উভয় দেশের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আক্কু ইউ হবে তুরস্কের প্রথম পারমাণবিক প্লান্ট জ্বালানি ক্ষেত্র। এটা হবে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার নিদর্শন। আঙ্কারা এ প্রকল্পটিকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যকার অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ও দ্বিপক্ষীয় জোট হতে পারে আরো বাস্তবসম্মত। তবে এতে আঙ্কারার সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে এবং তাদের বিদেশনীতির এজেন্ডা আরো হালকা হয়ে যেতে পারে টার্ক স্ট্রিম প্রকল্পের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক আরো জোরদার হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এরদোয়ান টার্কস্টিম প্রকল্পের অফশোর সেকশনের কাজ সম্পন্ন হওয়ায় এক টুইটার বার্তায় বলেন, টার্কস্টিম প্রকল্পটা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের অঞ্চলে জ্বালানি ভূ-রাজনীতির জন্য একটি ঐতিহাসিক আনুপাতিক প্রকল্প। আমরা আমাদের রাশিয়ার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এ প্রকল্পের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পুতিন টার্কস্টিম এবং আক্কু ইউ উভয় এ প্রকল্পকে রাশিয়া-তুরস্কের বহুমাত্রিক অংশীদারিত্বের অগ্রগতিশীল উন্নয়নের প্রতীক এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি বলে বর্ণনা করেন। তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তুরস্কের ন্যাটো সদস্য হওয়ার বিষয়টি সব সময় একটি প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হয়। আঙ্কারা এস-৩০০ সিস্টেম ক্রয় করার কারণে ওয়াশিংটন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং তুরস্কের কাছে আমেরিকার এফ-৩৫ ফাইটার জেট বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১৫ সালে রাশিয়ার একটি যুদ্ধবিমান আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে তুরস্ক বিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করে। এরপরই দুই দেশের মধ্যে দ্রুত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়। প্রথমে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিলেও পরে এ উত্তেজনা হ্রাস পায় এবং সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

সিরিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে উভয় দেশ কাছাকাছি আসে এবং দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে তাদের মধ্যকার যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। তুরস্ক, ইরান এবং রাশিয়ার নেতারা সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করার জন্য আশতানায় শান্তি আলোচনায় মিলিত হন। সিরিয়ার ইদলিব সংকট নিয়ে আলোচনার পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়্যেব এরদোয়ান ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন প্রকাশ্যে করমর্দন করেন। এরপর সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পর তুরস্ক ও রাশিয়ার কর্মকর্তা সম্প্রতি মস্কোতে একটি বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে তারা সিরিয়া নিয়ে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়। তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক এখন পর্যন্ত কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ওঠানামা এবং উত্তেজনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অতীতে রাশিয়ার প্রতি তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রথাগতভাবে ন্যাটো জোটের মতোই। তুরস্ক ন্যাটোর বাইরের দেশ হিসেবে রাশিয়ার ব্যাপারে ছিল সতর্ক। এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুরস্কের ইতিবাচক ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। এর সঙ্গে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুরস্কের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতা আনা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভবিষ্যতে ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করতে হলে তুরস্ককে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো-আঙ্কারা সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্কের দাবি অনুযায়ী ফতুল্লাহ গুলেনকে তুরস্কে প্রেরণে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে এবং মার্কিন ধর্মযাজক অ্যান্ড্রো ব্রুনসেনকে কারারুদ্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তুর্কি অর্থনীতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। সিরিয়ায় কুর্দি নেতৃত্বাধীন পিওয়াইডি কিংবা ওয়াইসি জিকে আমেরিকা সমর্থন দেওয়ায় তুরস্ক উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এটাও যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক শীতল সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে রাশিয়া-তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে আসে। তুরস্কের জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়ার কৌশলগত সমর্থন এবং সিরিয়ার ইদলিবে একটি অসামরিক অঞ্চল গড়ে তুলতে দুই দেশের যৌথ সিদ্ধান্তÑ এসব কিছু মস্কোকে আঙ্কারার একটি লাভজনক অংশীদারে পরিণত করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এরদোয়ান ও পুতিনের মধ্যে প্রায়ই বৈঠক হয়েছে। এতে এটা স্পষ্ট হয়েছে, রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ থেকে দূরে সরে গিয়ে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করেছে। অবশ্য এখনো দুই দেশের মধ্যকার গভীর সম্পর্কের বিষয়টি অলাভজনক বা অসুবিধাজনক এবং এর জন্য অনেক মূল্যও দিতে হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলকে আঙ্কারা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কিন্তু তখন থেকে এ পর্যন্ত তুরস্ক ওই বিষয় নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো বিতর্ক এড়িয়ে গেছে। কিন্তু ইদলিব ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের ঐকমত্যে পৌঁছানোর কারণ এরদোয়ানের দুর্বল অবস্থান। ইউরোপ-আমেরিকার মিত্রদের খেপিয়ে দেওয়ার পর রাশিয়া, ইরান ও কাতার ছাড়া আর কারো ওপর ভরসা করার সুযোগ তার নেই। সমঝোতা না হলে তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়া ও সিরিয়ার যুদ্ধ বেঁধে যেত আর তুরস্কের জন্য সেটা ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনত। উল্লেখ্য, যুদ্ধ বাঁধলে ইদলিব থেকে লাখ লাখ শরণার্থী তুরস্কে ধেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। পরিণতিতে তুরস্কে চাড়া দিয়ে উঠত গৃহযুদ্ধ। সর্বোপরি মস্কো-আঙ্কারা মুখোমুখি হলে সেই দ্বন্দ্ব সামরিক প্রেক্ষাপট ছাড়িয়ে তুরস্কের উচ্চাকাক্সক্ষী অভিলাষ পূরণে ব্যাপক বাধা সৃষ্টি করত। এতে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষা ও আঞ্চলিক নেতৃত্ব অর্জন, উভয় লক্ষ্যই বাধার মুখে পড়ত। তুরস্ক-রাশিয়ার এ মতৈক্যে নাখোশ যুদ্ধবাজ পশ্চিমের অপতৎপরতা দেখার জন্য কয়েক ঘণ্টাই যথেষ্ট ছিল। সিরিয়ায় হামলা করে বসল ইসরায়েল ও ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণও হয়তো ছিল। এবার তারা আগের মতো কোনো অজুহাতও দেখায়নি। তুরস্ক-রাশিয়ার চুক্তির ফলে পুরো সিরিয়ায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হবে, সেটা কিছুতেই মানতে পারেনি শত্রুপক্ষ। তাই তারা সিরিয়ায় হামলা চালায়। আগেরবার তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে অস্ত্রবিরতি চুক্তির আওতায় সিরিয়ায় যে বিমান হামলামুক্ত আকাশসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সেবার সিরিয়ার শত্রুপক্ষ ধরে নিয়েছিল, সিরিয়া দুই টুকরা হয়ে যাবে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা একদম আলাদা। ইদলিব ছাড়া অন্য কোথাও সেই আকাশসীমার প্রয়োজন পড়ছে না। চীন, রাশিয়া, ইরান ও সিরিয়ার কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক দক্ষতায় ইদলিবও এক দিন জিহাদি উপদ্রবমুক্ত হবে। সিরিয়ায় পশ্চিমাগোষ্ঠী ও ইসরায়েল মুখোশের আড়ালে থেকে হস্তক্ষেপের যত অপচেষ্টাই চালাক, তাতে ইদলিবের এ নিয়তি ঠেকানো যাবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close