মো. ওসমান গনি

  ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯

মতামত

বাড়িভাড়ার ভোগান্তিতে ভাড়াটিয়া

সরকারি আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ঢাকার বাড়ির মালিকরা ইচ্ছামতো তাদের ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছেন। প্রশাসনের নাকের ডগার সামনে এসব ঘটনা ঘটছে। প্রশাসন এসব দেখেও না দেখার ভান করে আছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ গ্রামে কর্মসংস্থানের অভাব হওয়ায় বেঁচে থাকার তাগিদে রাজধানীমুখী হচ্ছে। এতে আবাসনের তুলনায় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে নগরীতে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাড়িওয়ালা নিজের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। এ ছাড়াও সরকারিভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ধোঁয়া তুলে বাড়িভাড়া বাড়ানোর এ প্রবণতা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে এসে এ খাতে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার ভর্তুকি ঘোষণা করলেও রাজধানীতে বাড়িভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা এখনো থামেনি। প্রতি বছরের ডিসেম্বর থেকে বাড়িভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা থাকলেও এ বছর তা আগে থেকেই শুরু হয়েছে।

২৭ বছর আগে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন করা হলেও সেটি কোনো বাড়ির মালিক মানছেন না। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নতুন বছর ছাড়াও বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া বাড়ানো হয়; যা ভাড়াটিয়ার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এর পরও বাড়ি ভাড়া নৈরাজ্য রোধে দুই সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগ নেই। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুর্বলের পক্ষে নীতিনির্ধারণীরা কথা বলতে চান না। রাজধানীতে যারা ভাড়াটিয়া আছেন, তাদের পক্ষ নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি। সিটি করপোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্সের আশায় কখনো ভাড়াটিয়াদের পক্ষে ন্যায় পদক্ষেপ নেয়নি। ভাড়াটিয়াদের প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম না থাকায় বাড়িওয়ালারা নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বৃদ্ধি করেন। তাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত অসহায়ের মতো মেনে নিতে হয়। এতে চাকরির সিংহভাগের বেতন চলে যায় বাড়িওয়ালার পকেটে।

এলাকাভেদে ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া ইতোমধ্যে বৃদ্ধি করা হয়েছে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯৯০ সালে পাকা ভবনে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ২ হাজার ৯৪২ টাকা। ২০১৫ সালে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ টাকা। ২০০৬ সাল থেকে গত ১০ বছরে ভাড়া বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সময় ভাড়া বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার গুণ। ৯০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতি বছর বাড়তি ভাড়ার বোঝা ঘাড়ে নেয়। ধানমন্ডি, বনানী এলাকার চেয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নতুন সংযুক্ত হওয়ায় ৩৬টি ওয়ার্ডে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগায় বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়িছেন দ্বিগুণেরও বেশি। বাড্ডা, উত্তরা ১১, ১২ নম্বর সেক্টর কয়েক মাস আগেও যখন ইউনিয়নের আওতায় ছিল তখন ফ্ল্যাটের ভাড়া ৫-৬ হাজার টাকা ছিল। ডিএনসিসিতে যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ফ্ল্যাট ভাড়া বাড়িয়েছে ১০-১২ হাজার টাকা।

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের পর ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা ও অবস্থানভেদে ভাড়ার হারও নির্ধারণ করে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই হার পুনর্নির্ধারণ করে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউই তা আমলে নিচ্ছেন না। এ সুযোগে বাড়িওয়ালারা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে নিচ্ছেন। এক জরিপ থেকে জানা গেছে, ঢাকার ৮৩ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকে। এ তথ্য মতে, ৮৩ শতাংশ মানুষ ১৭ শতাংশ বাড়ি মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। ওই জরিপ সূত্রে আরো জানা যায়, সিটি করপোরেশন কর্তৃক গুলশান এলাকার প্রতি বর্গফুট বাড়ি ভাড়া ১৫ থেকে ১৮ টাকা, বনানীতে ১৪ থেকে ১৬, মহাখালীতে ১১ থেকে ১২, নাখালপাড়াতে ৬ থেকে ৭, উত্তরায় ৫ থেকে ৯, শান্তিবাগে ৫ থেকে ৬ টাকা, নয়াপল্টনে ৯ টাকা, শান্তিনগরে ৮ থেকে ৯, কল্যাণপুর-পল্লবীতে ৬, জিগাতলায় ৮ ও ধানমন্ডিতে ১১ দশমিক ২৫ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু বাড়ির মালিকরা ভাড়া আদায় করছেন এর দ্বিগুণ থেকে তিন গুণেরও বেশি।

নগরবাসীর সুখ-দুঃখ দেখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। সেখানে বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া দুপক্ষের স্বার্থ দেখতে হবে। সিটির উন্নয়ন কাজে ব্যয় বেড়েছে এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি পেয়েছে। হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির সঙ্গে কোনো এলাকার ভাড়া কেমন হবে, সেটি নির্ধারণ করা হয়েছে। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করা এবং কমানো এটি শুধু ডিএনসিসির একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ ঢাকায় যতগুলো সংস্থা রয়েছে প্রত্যেকের সমন্বয় প্রয়োজন। বাড়ি ভাড়া-সংক্রান্ত বিষয়ে আইনের প্রয়োগ না থাকায় কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। ক্যাবের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, প্রতি বছর ভাড়া বাড়ানোর কোনো নিয়ম না থাকলেও নতুন বছর এলেই এ দুই এলাকার ভাড়াটিয়াদের গড়ে অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভাড়া। জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৮ দশমিক ৭৭, ২০১৫ সালে ৬ দশমিক ৩৩, ২০১৪ সালে ৯ দশমিক ৭৬, ২০১৩ সালে ১০ দশমিক ৯১, ২০১২ সালে ৯ দশমিক ৭৩, ২০১১ সালে ১৫ দশমিক ৮৩, ২০১০ সালে ৫ দশমিক ৯৯, ২০০৯ সালে ১৪ দশমিক ৯৬, ২০০৮ সালে ২০ দশমিক ৫৯, ২০০৭ সালে ২১ দশমিক শূন্য ২, ২০০৬ সালে ১৪ দশমিক ১৪, ২০০৫ সালে ৭ দশমিক ৮৯, ২০০৪ সালে ৯ দশমিক ৯৬, ২০০৩ সালে ৮ দশমিক ৪, ২০০২ সালে ১৩ দশমিক ৪৯, ২০০১ সালে ১৭ দশমিক ৪, ২০০০ সালে ১৫ দশমিক ৮, ১৯৯৯ সালে ১৮ দশমিক ২৪, ১৯৯৮ সালে ১৪ দশমিক শূন্য ৯, ১৯৯৭ সালে ১৫ দশমিক শূন্য ৩ ও ১৯৯৬ সালে আগের বছরের তুলনায় ১৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বেড়েছে সারা দেশে। বিষয়টির প্রতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে দেশের বিজ্ঞ মহল।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close