মোমিন মেহেদী
জিজ্ঞাসা
গাইড ব্যবসার শেষ কোথায়
সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিনামূল্যে বই প্রদানের মধ্য দিয়ে বই উৎসবের রেশ কাটতে না কাটতে দেশের বিভিন্ন বই বিতানে শুরু হয়েছে নিষিদ্ধ গাইড বইয়ের রমরমা বাণিজ্য। বিগত পাঁচ দিন দেশের বিভিন্ন বই বিতান ও লাইব্রেরিগুলোতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। প্রশাসনের নজরদারি ও মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় অসাধু বই ব্যবসায়ীরা সবাইকে ঘুমে রেখে প্রশাসনের নাকের ডগায় গাইড বই বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, সরকারি বই বিতরণের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এ ব্যবসার সঙ্গে সারা দেশের বিভিন্ন প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিতানগুলোতে দ্বিতীয় শ্রেণির অনুপম, লেকচার গাইড বই বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা পর্যন্ত। তৃতীয় শ্রেণির অনুপম ও লেকচার গাইড বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৬০ টাকা, চতুর্থ শ্রেণির অনুপম, লেকচার ও পাঞ্জেরী গাইড বিক্রি হচ্ছে ৩২০-৩৫০ টাকা পর্র্যন্ত। পঞ্চম শ্রেণির লেকচার, অনুপম ও পাঞ্জেরী গাইড বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্র্যন্ত। ষষ্ঠ শ্রেণির অনুপম, লেকচার ও পাঞ্জেরী গাইড বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ থেকে ৬২০ টাকা পর্র্যন্ত। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির লেকচার, অনুপম ও পাঞ্জেরী বই ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্র্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সারা দেশে অবাধে নিষিদ্ধ গাইড বই বিক্রির কারণে কোমলমতি
শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভুক্তভোগী সচেতন নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার
মানোন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নিরন্তর রাজপথে থাকা জাতীয় শিক্ষাধারার মতো করে রাজপথকে শুধু রাজনীতির সূতিকাগার না করে শিক্ষা-সমাজ-সংস্কৃতি ও সভ্যতার জন্যও নিরন্তর এগিয়ে যেতে হবে।
প্রশাসন থেকে যদিও বলা হচ্ছে যে, ‘গাইড বই বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আর কোনো শিক্ষক এর সঙ্গে জড়িত থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তার পরও যারা বিক্রি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমি উপর মহলকে জানিয়েছি। আমরা অতীতেও বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে অভিযান চালিয়েছি। এবারও শিগগিরই গাইড ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ কিন্তু তাদের এসব কথা কেবল দৈনিকের পাতায় প্রকাশিত সংবাদ আর বড় বড় বুলি পর্যন্তই শেষ। সেই সুযোগে গড়ে উঠেছে হাসান বুক ডিপো, জুপিটার গাইড, পাঞ্জেরী গাইড, পপি গাইড, নবযুগ গাইড ও লেকচার গাইডসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। আর এ প্রতিষ্ঠানগুলো লোভের সর্বোচ্চ সীমায় চলে গেছে। এ প্রতিষ্ঠাগুলো ধর্ম ব্যবসার লেবাস লাগিয়ে একের পর অধর্মীয় কর্মকান্ড করেই যাচ্ছে। কখনো এরা তাবলিগি আলেম, কখনো পীরের মুরিদ সেজে ক্রমশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিশন দিয়ে নোট-গাইড তালিকাভুক্ত করে যাচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ নয়; স্টেশনারি এবং বইয়ের দোকানগুলোতে নিষিদ্ধ গাইড ও নোট বইয়ের ছড়াছড়ি। আইনানুযায়ী বাজারজাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও কমিশনে বিক্রি করা হচ্ছে গাইড ও নোট বই। অন্যদিকে নামিদামি স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উপঢৌকন দিয়ে গাইড ও নোট বই তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক আগেই নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। জাতির কল্যাণ বিবেচনায় নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সারা দেশে দেদার বিক্রি হচ্ছে নোট ও গাইড বই। পুরান ঢাকার বাংলা বাজারের কিছু অসাধু প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে এসব বই ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। এ অবস্থা বহু বছর ধরে চলে এলেও বন্ধ করতে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা নোট ও গাইড বইনির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা আর লাভবান হচ্ছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক ও অসাধু ব্যবসায়ী। এ অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নোট-গাইডের ব্যবসা বন্ধে নজরদারির কথা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নোট-গাইডের ব্যবসা কীভাবে চলছে, তার খোঁজ রাখে না এনসিটিবি। বাংলা বাজার থেকে এসব বই যাতে উৎপাদন ও
বাজারজাত হতে না পারে, এর ব্যবস্থাও নিচ্ছে না। ব্যবস্থা নিলে বাংলা বাজারের নোট-গাইড সারা দেশে সয়লাব হতো না। নীরব ঘাতক হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি পেত।
সারা দেশে শিক্ষা ধ্বংসের সব ষড়যন্ত্র যখন নির্মমতায় অগ্রসর হচ্ছে, তখন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিকে এগিয়ে আসতে হবে, গণমাধ্যম-প্রশাসনকেও রাখতে হবে যথাসাধ্য ভূমিকা। যে ভূমিকার হাত ধরে এগিয়ে আসবে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্র বলছে, নোট-গাইডের প্রভাবে শিক্ষার্থীরা বোর্ডের বই পড়ছেই না। বিভিন্ন স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় শিক্ষকরা গাইড বইয়ের অনুশীলনীর প্রশ্ন পরীক্ষার প্রশ্ন হিসেবে ব্যবহার করছেন। এতে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যার দিকে ঝুঁকছে। গাইড বইয়ের ওই উত্তরটি মুখস্থ করলেই পরীক্ষায় পাস করা যাবে। ফলে প্রশ্ন ফাঁসে ঝুঁকে পড়ছে তারা, যা কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। নোট-গাইডের ওপর নির্ভরশীল থেকে পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ইতিহাস বলছে, নোট বই প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে ১৯৮০ সালে একটি আইন করা হয়। কিন্তু সেই আইন যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়নি। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নোট বই ছাপানো বন্ধের উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রণালয় ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সরকারের অননুমোদিত নিম্নমানের বই, নোট ও গাইড বই বাজারজাত বন্ধ করতে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের সাহায্য নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়। অথচ ২০১৯ সালে এসেও নতুন বছরেও বাজারে দ্বিতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য বিভিন্ন নামে বিভিন্ন কোম্পানির গাইড ও নোট বই পাওয়া যাচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির গাইড ও নোট বইয়ের মধ্যে অন্যতম প্রকাশনী পাঞ্জেরী, লেকচার, অনুপম, নবদূত, জননী, পপি ও জুপিটার; নবম ও দশম শ্রেণির গাইড ও নোট বইয়ের প্রকাশনী পাঞ্জেরী, লেকচার, অনুপম, রয়েল, আদিল, কম্পিউটার ও জুপিটার এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির গাইড ও নোট বইয়ের প্রকাশনী হিসেবে লেকচার, পাঞ্জেরী, জ্ঞানগৃহ, জুপিটার, পপি, মিজান লাইব্রেরি, কাজল ব্রাদার্স, দি রয়েল সাইন্টিফিক পাবলিকেশন্সের বই পাওয়া যায়। এসব গাইড, নোট বই, টেস্ট পেপার, সহায়ক বই, মেড ইজিসহ বিভিন্ন নামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ নয়; পুরান ঢাকার বাংলা বাজারের প্রকাশনা সংস্থাগুরো নিষিদ্ধ ঘোষিত গাইড ও নোট বইয়ের জমজমাট ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। পুরান ঢাকায় নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বইয়ের ব্যবসা চালিয়ে আসা শীর্ষ প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে রয়েছে হাসান বুক ডিপো, লেকচার পাবলিকেশন্স, পাঞ্জেরী গাইড, জুপিটার ও গ্যালাক্সি। এ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অবৈধ ব্যবসাকে আড়াল করতে সৃজনশীল বই প্রকাশের জন্য বিকল্প প্রকাশনাও করেছে। যেমন লেকচারের ইঞ্জিনিয়ার মেহেদী হাসান বাংলা প্রকাশ করেছেন। এ প্রকাশনা থেকে দেশের বরেণ্য কবি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বন্ধু নির্মলন্দু গুণসহ দেশের রথী-মহারথী শতাধিক লেখকের বই প্রকাশ করেছে। যে কারণে সেই রথী-মহারথীদের সাহায্যে যত রকম দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসা সম্ভব করে যাচ্ছে লেকচার গাইড। একই পথে হাঁটছে পাঞ্জেরী, জুপিটার, হাসান বুক ডিপোসহ অন্য গাইড ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে এদের সৃজনশীল প্রকাশনা বটেশ্বর বর্ণন, জিনিয়াস, সাত ভাই চম্পাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মোহ লেখক সমাজের মধ্যে প্রবেশ করাচ্ছে টাকার লোভ। আর হাসান বুক ডিপো তো সবাইকে পেছনে ফেলে নেমে গেছে কুরিয়ার-পার্সেল আর স্টেশনারি ব্যবসায়। আড়ালে চলছে জমজমাট গাইড ব্যবসা, শিক্ষা ধ্বংসের মধ্য দিয়ে কিছু অমানুষের ধনী হওয়ার চেষ্টা। এ চেষ্টাকে এখনই প্রতিহত করতে হবে। নতুন বছরেই পদক্ষেপ নিতে হবে
বাংলাদেশে শিক্ষাকে কোনোভাবেই ব্যবসার পণ্য বা ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। আর তাই চাই নতুন বছরে নতুন প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমাদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল টিম গঠন করতে হবেÑ এ গাইড ব্যবসা বন্ধের নিমিত্তে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
"