আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

পর্যটনে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ

পর্যটন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম আয়ের খাত। অনেক উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম আয়ের খাত হচ্ছে পর্যটন। পর্যটনশিল্প অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য খরভব ইষড়ড়ফ হিসেবে কাজ করে ওইসব দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। অধিকন্তু পর্যটন কর্মকান্ড মানুষের জন্য আনন্দের জোগান দেয়, দৈনন্দিন জীবনে কিছু সময়ের জন্য হলেও স্বস্তি আনয়ন করে এবং অবকাশযাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে। পর্যটনের মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে জানতে পারে, দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে পর্যটকরা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে এবং অন্যান্য মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক-সামাজিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে পারে। ফলে প্রতিটি পর্যটন-গন্তব্যের সরকার এবং পর্যটন ব্যবসায়ীরা এ শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দান করে তার উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি, ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এ ছাড়াও বিশ্ব পর্যটন

সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্প হতে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০ দশমিক ৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে, তা হলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

আমাদের পর্যটনশিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থকলেও পাশের দেশগুলোর তুলনায় আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের পাশের অনেক দেশ যেখানে এ শিল্পের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; সেখানে আমরা স্থবির হয়ে আছি। সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ানের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। মালদ্বীপের অর্থনীতির বেশির ভাগই আসে পর্যটন খাত থেকে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অ্যান্ড ট্যুরিজম করপোরেশনের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৯ ভাগ। ২০২০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ বেড়ে ৪ দশমিক ১ ভাগ হবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আবার বাংলাদেশ বর্তমানে এ খাত থেকে যেখানে প্রায় ৭৬ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার বার্ষিক আয় করে; সেখানে সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ১০,৭২৯ মিলিয়ন ডলার, মালদ্বীপে ৬০২ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানে ২৭৬ মিলিয়ন ডলার এবং নেপালে এর পরিমাণ ১৯৮ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পর্যটনশিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আদর্শ হতে পারে। পর্যটন একটি বহুমাত্রিক ও শ্রমঘন শিল্প। সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বৃহৎ বাণিজ্যিক কর্মকান্ড হিসেবে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় পর্যটন খাত থেকে। পর্যটনশিল্পে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর, যেমনÑ পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইনস ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। আমাদের সম্ভাবনাও প্রচুর রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।

বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। ইতোমধ্যে পর্যটন বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের এক-তৃতীয়াংশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনশিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতি বছর দুই ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে। এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পর্যটনশিল্প বড় নিয়ামক হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বহুমাত্রিক পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে শুধু কক্সবাজারে। বহুমাত্রিক পর্যটনে সাংস্কৃতিক, ইকো, ¯েপার্টস, কমিউনিটি ও ভিলেজ ট্যুরিজম ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। পর্যটকদের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির অভিপ্রায়ে কক্সবাজারে রাজধানী নগরী ঢাকা থেকেও বেশি হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। সব পর্যটনকেন্দ্রেই বেসরকারি উদ্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে।

তবে কক্সবাজার বাদে অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটে তেমন আধুনিকায়ন হয়নি। তবে ধীরে ধীরে হচ্ছে অনেক স্পটে। পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়ে উন্নয়ন যথেষ্ট চোখে পড়ার মতো। তবে বিনোদনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। পর্যটন খাতে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে হবে। বিদেশিদের জন্য আলাদা আবাসিক ব্যবস্থা বা বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বে চীনা পর্যটকরা বেশি ব্যয় করে। চীনের নাগরিকের বেশির ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাই তাদের আকৃষ্ট করতে বৌদ্ধ স্থাপনাগুলোতে যোগাযোগ ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। চীনা পর্যটকদের আনতে পারলে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে। থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় পর্যটন খাতে অনেক এগিয়ে। দেখা যায়, চীনা পর্যটকের হার অনেক বেশি এ দুই দেশে। ভারতেও পর্যটন থেকে আয় অনেক হয়। কিন্তু শুধুমাত্র চীনা-জাপানিদের উল্লিখিত দুই দেশের সমান হতে পারেনি। তাই উল্লিখিত দুই দেশ থেকে ভারত পিছিয়ে। বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে জাতীয় পরিকল্পনায় পর্যটনশিল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পর্যটন পুলিশ গড়ে তোলা, পরিকল্পিত প্রচারণা চালানো, দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং পরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন। পর্যটন স্থানগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো আবশ্যক। নিরাপত্তার অভাব, চুরি বা ছিনতাই, রাস্তা বা ট্যুরিস্ট স্পটের নোংরা পরিবেশ ইত্যাদি বিদেশিদের কাছে চিন্তার কারণ। অনেক স্পটে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। ট্রেন যোগাযোগ বিদেশিরা পছন্দ করে। এটি আরামদায়ক। তাই রেলব্যবস্থার উন্নয়ন ও লাইন সম্প্রসারণ করতে হবে। তবে বর্তমান সরকারের আমলে রেলের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। দক্ষ গাইডের অভাব বাংলাদেশে। ইংরেজি বা বিদেশি ভাষায় দক্ষ গাইড বিদেশিদের সন্তুষ্ট করতে পারবে। এগুলো দূর করতে পারলে বিদেশিদের আকৃষ্ট করা যাবে।

পর্যটনে সম্ভাবনাময় একটি দেশ হচ্ছে আমাদের

বাংলাদেশ। একটু নজর দিলে এ খাত থেকে প্রচুর আয় করা সম্ভব। এটিকে বলা হয় অদৃশ্য অর্থনৈতিক শক্তি। পর্যটন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম আয়ের খাত। অনেক উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম আয়ের খাত হচ্ছে পর্যটন। পর্যটনশিল্প অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য ‘খরভব ইষড়ড়ফ’ হিসেবে কাজ করে ওই সব দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close