রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২২ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

নতুন মেরূকরণে ভারত-বাংলাদেশ-চীন

স্নায়ুযুদ্ধকালে সোভিয়েত-মার্কিন ক্ষমতা বিস্তারের প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ শক্তি ভারত ছিল সোভিয়েত বলয়ে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময়কালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে থাকা জওয়াহেরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকদের ভালো সম্পর্ক থাকলেও তার আদর্শগত ভাবনা-চিন্তায় সমাজতন্ত্রের প্রভাব দৃশ্যমান ছিল। ব্রিটিশ-সোভিয়েত যৌথ প্রভাবে তিনি স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রিক মূলনীতি ও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের সমন্বয় আনতে চেয়েছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় উদ্যোগগুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে মুক্তভাবে শিল্প বিকাশের সুযোগ দেন। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সংক্ষিপ্ত সময়ের পর নেহরু-তনয়া ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে বাবার অনুসৃত নীতিই এগিয়ে নিয়ে যান। বাবা-মেয়ের দুই আমলেই দৃশ্যমান নীতি হিসেবে ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিলেও কার্যক্ষেত্রে সোভিয়েত বলয়ে অবস্থান নেয়। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান অবধি ভারত সরকারের এ নীতি অনুসৃত হতে থাকে। স্নায়ুদ্বন্দ্বের অবসানে সোভিয়েতের পরিবর্তে রুশ অধ্যায় শুরু হলে দিল্লি এক ধরনের ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করতে শুরু করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নের পথে পা বাড়ায়। নরসিমা রাও, অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং মনমোহন সিংয়ের চার মেয়াদে ধীরগতিতে ভারতের কৌশলগত অবস্থান ও পররাষ্ট্রনীতি ওয়াশিংটনমুখী হতে শুরু করে। বাংলাদেশকেন্দ্রিক চীন-রাশিয়া-ভারত মেরুকরণটি এখানে থেমে থাকবে বলেও মনে হয় না। এর পরবর্তী প্রভাব দেখা যেতে পারে আফগানিস্তানে এর মধ্যে সেখানে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিরূপ মন্তব্য করেছেন।

এ ছাড়া তালেবান ইস্যুতে একটি বোঝাপড়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে ওয়াশিংটনের। বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের ব্যাপারে চীন বরাবরই সাধারণ এশীয় অবস্থান নেওয়ার কথা বলত। এ অঞ্চলে যাতে আমেরিকান প্রভাব বাড়তে না পারে, সেজন্য পারস্পরিক সহযোগিতার কথা বলত। এ অবস্থানের বিপরীতে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াবাড়ি রকমের পর্যায়ে উপনীত হওয়ার ফলে ডোকলাম সংকটের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বকে বেইজিং এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়, যাতে ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় কৌশলগত নীতিতে আকস্মিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এ পরিবর্তনে আমেরিকামুখী নীতিকৌশলের পরিবর্তন ধীরমাত্রার বদলে দ্রুতগতির মাত্রা নেয়। প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা চুক্তিসহ অনেকগুলো কৌশলগত সহায়তা চুক্তি হয় দিল্লি-ওয়াশিংটনের মধ্যে। নরেন্দ্র মোদি এ সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতকে মহাশক্তি তথা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ও পরমাণু প্রযুক্তি রফতানিকারক দেশের পর্যায়ে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখায়। বাস্তবে এর কোনোটাই অর্জিত হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে প্রতিরক্ষা সামগ্রী আমদানি এবং ভারত মহাসাগরে মার্কিন মিত্র জাপান-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যৌথ মহড়া ও প্রতিরক্ষা জোট গঠনের উদ্যোগে চীনের সঙ্গে বৈরিতা বৃদ্ধি পায় দিল্লির। এর ফলে একদিকে ডোকলাম সংকটের মতো সীমান্ত সংঘাত বৃদ্ধি পায়; অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের যৌথ প্রতিরক্ষা উদ্যোগ জোরদার হয়। রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক তৈরি হয় ইসলামাবাদের।

এই মেরুকরণ দিল্লির নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তোলে। ভারতের অনেক নীতিনির্ধারক ভারসাম্য নীতি গ্রহণের পক্ষে অবস্থান নেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কৌশলগত চিন্তাবিদ পরাগ খান্না ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ভারত কখনোই যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মতো পরাশক্তি হবে না। কিন্তু তিনি এটাও বলেন, এ দেশটি বিশ্বব্যবস্থার দিক বদলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এশিয়াতে তো বটেই। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন সবাই যদি ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়, এ কারণে যে ভারসাম্য রক্ষায় ভারত ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে বড় ধরনের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না জড়িয়েও সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব রাখতে পারবে। শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি আবার রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নতুন করে এস ৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় ও নিরাপত্তা খাতে বিভিন্ন চুক্তি হয় দিল্লি-মস্কোর মধ্যে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে রুশ-চীন লাইনে দিল্লির অবস্থান আগে থেকেই এর একটি ভিত সৃষ্টি করে। ভারতের সাউথ ব্লকে নীতিনির্ধারণ পর্যায়েও এর মধ্যে পরিবর্তন আসে। পররাষ্ট্র সচিব পদে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এস জয়শঙ্করের স্থলাভিষিক্ত হন চীনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী বিজয় কেশব গোখলে। জয়শঙ্করের অগ্রাধিকার যেখানে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করা, সেখানে গোখলের অগ্রাধিকার হয় চীনের সঙ্গে বৈরিতার জায়গাগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে যেখানে সম্ভব সেখানে ভারত-চীন সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করা। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ১০ দিন আগে ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক সুবির নন্দী লিখেছিলেন, ‘গোখলের কৌশল ৩০ ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে কিছুটা পরীক্ষার মুখে পড়বে।

অন্যদিকে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা দুই জায়গাতেই ভারতের বন্ধুরা নৈতিকভাবে একটা শক্ত অবস্থানে ছিল। তারা যাদের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন তাদের অবস্থান ছিল দৃশ্যত গণতন্ত্রের বিপক্ষে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এবং সফল গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে এসব ব্যক্তির সমর্থন দেওয়া ভারতের জন্য সহজ ছিল। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভেস্তে গেছে। কারণ ভারত যে উচ্চ নৈতিক অবস্থান কামনা করে, ংেসটা এখানে নেই। পশ্চিমা দেশগুলো হাসিনার বিরুদ্ধে দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিযোগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে এটা বোঝাতে ভারতের বেগ পেতে হচ্ছে যে, হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে সেটা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভালো হবে। এখানে পাশ্চাত্যের দেশগুলো যেখানে মুক্ত, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কার্যকর অভিযাত্রা চেয়েছে, সেখানে ভারত চীনের সঙ্গে মিলে এমন এক নির্বাচন করতে শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন সরকারকে সমর্থন করেছে; যার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের নির্বাচনকে তুলনা করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। মনে হয়, এখানে দিল্লি-বেইজিং সমঝোতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এ অঞ্চলে আমেরিকান প্রভাবকে গভীর হতে না দেওয়া। অথচ ২০০৭-০৮ সালে ভারতের প্রভাবকে বাংলাদেশে সর্বব্যাপী করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। এবার ওয়াশিংটন মনে করেছিল, এখানে একটি মুক্ত, উদার নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দিল্লির সহযোগিতা পাওয়া যাবে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর উল্টোটাই হয়েছে। এমনকি জি২০ সম্মেলনের ফাঁকে আরেকটি ত্রিদেশীয় বৈঠক হয়েছে, যেখানে একত্র হয়েছিল রাশিয়া, চীন ও ভারত।

কিন্তু কার্যত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ত্রিদেশীয় এ প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে ইউরেশিয়ান প্রচেষ্টা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন; যেখানে ভারত ও চীনের সঙ্গে আরআইসি ফরম্যাটকে নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত করা হবে। পুতিন যে নিয়মিত আরআইসি বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন, সেখানে চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নয়নকে উৎসাহিত করার জন্য রাশিয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে এ বাস্তবতাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে ভারত ও চীনের স্বার্থ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্পূরক নয়। ফলে নির্বাচনে জয়ের জন্য শেখ হাসিনা প্রথম দুটি অভিনন্দন বার্তা ভারত ও চীনের কাছ থেকে পেলেও আগামীতে তা অব্যাহত নাও থাকতে পারে। এমন কথাও এখন শোনা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভা থেকে পুরনো যাদের ছেঁটে ফেলেছেন তাদের বেশির ভাগই দিল্লির ঘনিষ্ঠ। ফলে নতুন সরকারে ভারতের চেয়ে চীনা প্রভাব বেশখানিকটা বাড়তে পারে। ভারতীয় বিশ্লেষক ভরত ভূষণের লেখায়ও সেটির প্রকাশ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতাকে ভারত ও চীন উভয়ে স্বাগত জানালেও তাদের স্বার্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। চীন প্রথমত চায় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ও দ্বিতীয়ত ভারতের মোকাবিলায় কৌশলগত পা রাখার জায়গা।

এ খেলায় শক্তিধরদের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা যেমন রয়েছে, তেমনিভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সম্পৃক্ততাও রয়েছে। অল্প কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সম্পৃক্ত হতে পাশ্চাত্যের কোম্পানিগুলোকে বেশি দেখা যেত। কয়েক দিন আগে রাশিয়ার গ্যাজপ্রম এ এলাকার ব্লক ইজারা পাওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। চীনও তার আগ্রহের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশকে। কৌশলগত খেলার পরিণাম অনেক সময় বেশ ভয়ংকরও হয়ে দাঁড়ায়। তেমন একটি অবস্থা এ অঞ্চলে না আসুক, সেটিই সবার প্রত্যাশা। দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিগুলোর প্রভাব-প্রতিযোগিতা নতুন অবয়ব নিতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলে এক দশক আগে পরাশক্তিগুলোর যে মেরূকরণ দেখা গিয়েছিল, তা এখন বেশখানিকটা পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এ পরিবর্তনে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশে চীন-ভারতের যে প্রীতিভাব তার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও পড়তে পারে। এরপর শ্রীলঙ্কায় এখন যে সিরিসেনা-রাজাপাকসে-বিক্রমাসিংহে যুদ্ধংদেহী অবস্থা চলছে, তার অবসানেও গোখলে তত্ত্ব কাজ করতে পারে। এটি নেপালেও ভারত-চীনের মধ্যে সহাবস্থান সৃষ্টি করতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে রোহিঙ্গা ইস্যুতেও। পশ্চিমা দেশগুলো এ মেরূকরণকে কীভাবে নেয়, সেটিই হলো দেখার বিষয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close