নিতাই চন্দ্র রায়

  ২১ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বাঙালি জাতির কোনো আপস নেই। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছে, পাকপশুদের হাতে যারা আমাদের মা-বোনদের তুলে দিয়েছে, তাদের বাঙালি জাতি কোনো দিন ক্ষমতায় দেখতে চায় না। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল, বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ও ভাবমূর্তির কাছে খড়-কুটার মতো ভেসে গেছে বিএনপির প্রচার-প্রচারণা এবং তারেক রহমানের অপরিপক্ব ও নীতিহীন নির্বাচনী কৌশল। ভেসে গেছে ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম আব্দুর রব ও বঙ্গবীর কাদের ছিদ্দিকীদের আত্ম-অহংকারসূচক হুঙ্কার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ৪৭ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া ২৭ জন এর আগে কখনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেননি। প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় যুক্ত হওয়াদের মধ্যে ৯ জন পূর্ণমন্ত্রী, ১৫ জন প্রতিমন্ত্রী ও তিনজন উপমন্ত্রী রয়েছেন। ২০১৪ সালের মন্ত্রিসভার পুরনোদের মধ্য থেকে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, পরিবেশমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও রেলমন্ত্রী মুজিবুর হকসহ অনেকেই বাদ পড়েছেন। বাংলাদেশের গত ১০ বছরের চোখ ধাঁধানো অভাবনীয় উন্নয়নের পেছনে এসব মন্ত্রীর অপরিসীম অবদানের কথা অস্বীকার করা যাবে না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নির্বাচনের আগে অবসর নেওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করায় তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হননি। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও ডা. দীপু মনি ২০০৮ সালের সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, তাদের একেবারে নতুন বলা যাবে না। তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি একেবারে শূন্য নয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ারর আলম এবং টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের মতো মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা আবার স্বপদে বহাল রয়েছেন। নতুনরাই যুগে যুগে পৃথিবীতে পরিবর্তনের পতাকা উড়িয়েছেন। নতুন চিন্তা, চেতনা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে সমাজ, দেশ ও মানবজাতিকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। আলো হাতে আঁধার তাড়িয়েছে। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অবদানই উল্লেখযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুনদের সততা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্তব্যপরায়ণতার অতীত ইতিহাস ও কর্মকান্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেই মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এবারের মন্ত্রিপরিষদে যেমন কৃষকের ছেলে আছেন, কৃষিবিজ্ঞানী আছেন, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আছেন, তেমনি আছেন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, অর্থনীতিবিদ ও কম্পিউটার বিশেষজ্ঞরা।

মানুষ পরিবর্তন চায়। ঘুষ-দুর্নীতির অভিশাপ থেকে মুক্তি চায়। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মাদকমুক্ত সমাজ চায়। দূষণমুক্ত পরিবেশ চায়। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন চায়। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপদ সড়ক চায়। পুষ্টিকর খাবার ও বিশুদ্ধ পানি চায়। উন্নত চিকিৎসা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা চায়। যানজট, জলাবদ্ধতামুক্ত পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ চায়। ভূমিহীন মানুষ খাসজমি চায়। মানুষ মানসম্মত শিক্ষা, গাইড বই ও কোচিং বাণিজ্য থেকে পরিত্রাণ চায়। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার পরিসমাপ্তি চায়। চাকরি ও বদলি বাণিজ্য বন্ধ চায়। কোটা পদ্ধতির সংস্কার চায়। দখল ও দূষণমুক্ত নদী চায়। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য চায়। ভেজাল বীজ, সার ও বালাইনাশকের ব্যবসার অবসান চায়। ইটভাটার অত্যাচার থেকে বাঁচতে চায়। ধনী গরিবের লাগামহীন বৈষম্যের অবসান চায়। স্থানীয় সরকারের স্বশাসন চায়। নগর সরকার ও নগরীয় কৃষি চায়। বর্জ্য থেকে জৈবসার ও বিদ্যুৎ চায়। জনগণের দল আওয়ামী লীগই এসব প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশার পতাকা নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে তুলে দিয়েছেন ১০ কোটি ৪০ লাখ ভোটারের হাতে। স্বপ্ন দেখিয়েছে শোষণহীন সমৃদ্ধ সমাজের। জাতির জনকও সেই স্বপ্নই দেখতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে নতুন মন্ত্রীদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সর্বোচ্চ সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, দেশপ্রেম, পেশাদারিত্ব, স্বাধীনতার চেতনা এবং জাতির জনকের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনার প্রত্যাশা পূরণে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। সম্প্রতি কৃষক শ্রমিক পার্টির এক আলোচনা সভায় সাবেক শিল্পমন্ত্রী সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়–য়া বলেন, রাজনীতি কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়। ব্যবসার জন্য রাজনীতি করা যাবে না। রাজনীতি হচ্ছে জনগণের সেবা করা। এ কথা কজনে বিশ্বাস করেন? তার মতে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে অগ্নিমশাল জ্বালাতে হবে। অগ্নিমশাল জ্বালাতে হবে সন্ত্রাস, মৌলবাদ, মাদক ব্যবসা, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ এবং ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাতের মতে, দেশে মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। বেকারত্ব দূর করতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রীর কথা, ব্যাংক কোম্পানি আইনের কিছু ত্রুটি আছে। সেগুলো সংশোধন করে বাস্তবায়ন করলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে যাবে। কারো কারো মতে, আওয়ামী লীগ মানুষের জীবনযাত্রার প্রয়োজন মাথায় রেখেই নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করেছে। ইশতেহারে একজন মানুষের বেঁচে থাকার সব উপাদান রয়েছে। ফলে ইশতেহার বাস্তবায়ন হলেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ভিশন-২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ। বর্তমান সরকারকে তরুণদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে এক কোটি বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের অঙ্গীকার আছে। এ ছাড়া বর্তমান সরকারকে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। সুশাসনের ফসল যাতে সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। কেউ কেউ সরকারের কাছে তাদের অঙ্গীকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন চান। চান নারীর নিরাপত্তা এবং কর্মক্ষেত্র ও পরিবহনে নারী লাঞ্ছনার অবসান। ইশতেহারে ঘোষিত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হলে দেশ আরো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারের হাতে থাকা মেগা প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত হলে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা ও সম্মান আরো বৃদ্ধি পাবে। মাথা উঁচু করে বলা যাবে, বাংলাদেশ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবের সোনার বাংলা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

যে যাই বলুক, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তর করতে হলে স্বশাসিত, স্বনির্ভর ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। স্থানীয় সরকারের সঠিক স্তরবিন্যাস করতে হবে। প্রতিটি স্তরে জাতীয় সরকারের অনুরূপ বিধানিক, নির্বাহিক ও বিচারিক বিভাগ সৃষ্টি করতে হবে। নাগরিকদের অভিযোগ-অনুযোগের নিষ্পত্তির জন্য স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে ন্যায়পাল নিয়োগ করতে হবে। প্রতিটি নগরে একরূপ নগর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পররাষ্ট্র, বৈদেশিক বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা প্রভৃতি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে বাকি সব উন্নয়নমূলক কাজ পর্যায়ক্রমে স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান, পরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, নগরীয় কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লি., নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close