এস এম মুকুল

  ২১ জানুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

বোধদ্বয়ের আন্দোলন এবং...

বই মানুষের সময় কাটানোর অন্যতম উপায়। যদিবা এখন সেই স্থান দখল করেছে ফেসবুক, মোবাইল, ইন্টারনেট, ইউটিউব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এসব করে দৃশ্যমান সামাজিক দক্ষতা বাড়লেও স্থায়ী মননশীলতার কোনো উন্নতি হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ফেসবুক, মোবাইল, ইন্টারনেট, ইউটিউবসহ অন্য সব সামাজিক মাধ্যম বরং প্রজন্মকে আারো অসহনশীল, অশালীন, অমার্জিত এমনকি অসামাজিক করে তুলছে। আচারে অনুষ্ঠানে, সামাজিকতায়, ঘরে-বাইরে সবখানে এখনকার বইপ্রীতিহীন ডিজিটাল প্রজন্মের মাঝে সুশিলীতা লক্ষ করা যায় না। এসব সামাজিক মাধ্যমের অনেক ভালো দিক থাকলেও অনেক খারাপ বা নেতিবাচক দিকগুলোই বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে; যা বই পড়–য়া প্রজন্মের সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রজন্মের মেধাবী সন্তানরা যেভাবে সামাজিক ডিজিটাল মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে অকাতরে সময় নষ্ট করছে, যদি তারা বই পড়ার পেছনে এর অর্ধেক সময় ব্যয় করত তা হলে মেধায়, মননে, সৃজনে একটি রুচিশীল, মানবীয় বোধসম্পন্ন প্রজন্ম দেশকে আলোকোজ্জ্বল করে দিতে পারত। বই পড়ে জ্ঞানের ভুবনে মানুষ আপন মনে বিচরণ করতে পারে। মানুষকে পরিশীলিত ও বিশুদ্ধ জ্ঞান ও আনন্দ দিতে পারে বই। কেননা পুস্তক হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ; যার সঙ্গে পার্থিব কোনো ধন-সম্পদের তুলনা হয় না। মানুষের ধন-রতœ, অঢেল সম্পদ একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু একটি ভালো বইয়ের শিক্ষা কখনো নিঃশেষিত হয় না। কিন্তু তবু আমরা বই পড়া থেকে অনেকদূরে সরে যাচ্ছি কেন এবং কেন এই উত্তর আমাদেরই খোঁজে বের করতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বইয়ের সংস্পর্শে এবং বই পড়ে শোনানোর মধ্য দিয়ে বড় করে তোলা শিশুদের সহজে ভাষা শেখা ও স্কুলে সাফল্যের সংযোগ রয়েছে। বই মানুষের মধ্যে দয়া, বিনয় ও সৃজনশীলতার বিকাশে সাহায্য করে। এসব কারণে বই পড়া খুব জরুরি। সন্তানদের হাতে বই তুলে দেওয়া আরো বেশি জরুরি। কিন্তু আমরা বাবা-মায়েরা সন্তানদের সহজে বই কিনে দিতে চাই না। মনে করি, এ টাকাটাই বুঝি গচ্চা গেল। অথচ এই বাবা-মায়েরাই পরিশীলিত ও মানবীয় সুসন্তান প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমরা আগে ভাবি না যে, সন্তানের মানবীয় বিকাশে বইয়ের গুরুত্ব ও অবদান সবচেয়ে বেশি। আমরা এই বাবা-মায়েরাই নির্দ্বিধায় চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বা অভিজাত হোটেলে বসে এক-দুই হাজার টাকা অবলীলায় খরচ করতে কার্পণ্য করি না। আমরা জানি, অনেক বিশেষজ্ঞ ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাথাকে শান্ত ও দুশ্চিন্তামুক্ত করার জন্য বই পড়ার উপদেশ দিয়ে থাকেন। কারণ বই পড়ে মানুষ মুক্ত চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে। গভীর মগ্ন হয়ে পড়ার অভ্যাসে ব্রেনের ফিজিক্যাল পরিবর্তন ঘটে। যারা খুব মগ্ন হয়ে বই পড়ে, তারা বাস্তব জীবনে অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়। অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার যে চিরন্তন আগ্রহ, তা বই পড়ে মেটানো যায়। একটি উত্তম বই মানুষকে মহৎ হতে শেখায়, মনকে প্রসারিত করে, বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে জীবনকে করে তালে পরিমার্জিত। আবার বই মানুষের সময় কাটানোর অন্যতম উপায়। এখন সেই স্থান দখল করেছে ফেসবুক, মোবাইল, ইন্টারনেট। এসব করে দৃশ্যমান সামাজিক দক্ষতা বাড়লেও স্থায়ী মননশীলতার কোনো উন্নতি হয় না। পক্ষান্তরে বই পড়ে জ্ঞানের ভুবনে মানুষ আপন মনে বিচরণ করে। মানুষকে পরিশীলিত ও বিশুদ্ধ জ্ঞান ও আনন্দ দেয় বই। কেননা পুস্তক হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যার সঙ্গে পার্থিব কোনো ধন-সম্পদের তুলনা হয় না। মানুষের ধন-রতœ, অঢেল সম্পদ একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু একটি ভালো বইয়ের শিক্ষা কখনো নিঃশেষিত হয় না।

আমাদের বই ক্রেতা বা বই পাঠক সমাজের মধ্য বিশেষ শ্রেণিটির নাম মধ্যবিত্ত। এখনো মধ্যবিত্তরাই বেশি বই কেনেন বলে আমারও ধারণা। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যাপ্তি যতটা বিকশিত হয়েছে বই কেনার রীতি ততটা বাড়েনিÑ এটা হতাশাজনক। আমাদের সমাজের একটি পরিবারের বইমেলায় বই কেনার জন্য ২ হাজার টাকাও বাজেট থাকে না। মেলা ঘুরেও এর বাস্তবতা লক্ষ করা গেছে। অথচ বাণিজ্য মেলায় উপচে পড়া ভিড়ে ৫-১০ হাজার টাকা খরচা করার বাজেট থাকে। এখন ভাবার সময় এসেছে সন্তানের জন্য বইও প্রয়োজন, সংসার সাজাতে সামগ্রীও প্রয়োজনÑ এখন আপনি কোনটিকে অধিক গুরুত্ব দেবেন, ভেবে দেখুন। আপনি ভেবে দেখুন, আমাদের পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কত কোটি। আমাদের সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সৃজনশীল বই কিনে পাঠাগার স্থাপন করা বাধ্যতামূলক হলে শতকোটি টাকার বই বিক্রি হওয়ার কথা। আশ্চর্য লাগে এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। গৎবাঁধা বক্তৃতা না করে বইশিল্পের বিকাশে উদ্ভাবনীমূলক কার্যক্রম তৎপরতা বাড়ানো দরকার। এজন্য লেখক সমাজকে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অবকাশ আছে বৈকি।

বই পড়ার অনেক উপকার। বই পড়লে শব্দভান্ডার বাড়বে, স্মরণশক্তি বাড়বে, ভাবনা আর কল্পনার জগৎ বড় হবে, সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটবে। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকসের গৃহীত নীতিনির্ধারণী অবস্থানে বলা হয়েছে, জন্মের পর থেকেই পড়াশোনার বিষয়টি প্রাথমিক শিশু পরিচর্যার অংশ হওয়া উচিত। এর অর্থ ছোট বাচ্চাদেরও বই পড়ে শোনানোর গুরুত্ব সম্পর্কে মা-বাবাদের সচেতন করা শিশু চিকিৎসকদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমাদের দেশে এই চর্চা একেবারেই নেই। মনে রাখতে হবে, আমরা যত বই পড়ব, মনের চক্ষু ততই খুলবে। আজকের দিনের অস্থির সমাজের অহমিকার ব্যারিকেড ভেঙে দিতে পারে বই পড়া আন্দোলন। আপনার সন্তানকে মোবাইল, ইন্টারনেট আর ফেসবুকের নেশা কাটিয়ে দিতে পারে বইয়ের নেশা। কিন্তু সে নেশাটি ধরাতে হবে অভিভাবকদের প্রাণান্তকর চেষ্টায়। সন্তানদেরক মাদক আর জঙ্গিবাদ এমন সব বিপথগামিতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে বই পড়া।

আমাদের সমাজে অদ্ভুত আরেকটি রীতি দুঃখজনকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছেÑ এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এমনকি শিল্প বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বনভোজনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে এখন বই উপহারের বদলে গৃহসামগ্রী দেওয়া হয়। অথচ এসব আয়োজনে বইকে প্রাধান্য দিলে এই সিজনে কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হতে পারত। সৃজন ও মননশীল জাতি গঠনের স্বার্থে এ বিষয়গুলোতে সবার মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

দুঃখজনক সত্যি হচ্ছে, বাংলাদেশে বইকেন্দ্রিক সামাজিকতা এখনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। ছোটবেলায় আমরা বই চুরি করে বা লুকিয়ে নিয়ে পড়তাম। বই বদল করে পড়তাম। বই উপহার পেতাম এবং বই দিতাম। এখন কেন জানি এ অভ্যাসে ভাটা পড়েছে। আমাদের সমাজে অনেক অভিভাবক পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়লে রাগ করেন। তাদের ধারণা, পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়লে লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। এ ধারণা মুটেও সঠিক নয়। বইয়ের বিকল্প বই-ই শুধু হতে পারে। একসময়ে মানুষ অবসর কাটাত বই পড়ে। গল্প-গুজবে, আড্ডায় ছিল কবিতা আর গল্পের চরিত্র নিয়ে মুখরতা। কোথায় যেন হারিয়ে গেল সব। প্রযুক্তির অবগাহনে বই পড়ার জায়গা টেলিভিশন, কম্পিউটার আর স্মার্টফোনে যেন কেড়ে নিয়েছে। তাই বলে কি বইয়ের চাহিদা কম্পিউটার, মোবাইল বা টেলিভিশন দ্বারা পূরণ করা সম্ভব? ভেবে দেখারও উপযুক্ত সময় এখনি।

স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছরে এসব জরাজীর্ণতার মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে লাখ লাখ তরুণ পাঠক। বইয়ের মাধ্যমে বোধ পরিবর্তনের এ আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে আমাদের বাংলা একাডেমি; লেখক, প্রকাশক সর্বোপরি প্রাণপ্রিয় এ বইমেলা। বইমেলার মধ্য দিয়ে বই কেনা, উপহার দেওয়া এবং বই পড়ার অভ্যাস বাড়ে। এ ধারাবাহিকতা আমাদের এগিয়ে নিচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে পাঠক ধরে রাখা এবং নতুন পাঠক সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রকাশক, লেখক ও বাংলা একাডেমিককে আরো নতুন এবং যুগোপযোগী উদ্যোগ নিতে হবে। বই প্রকাশ, বইমেলা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে প্রকাশনা শিল্পটি লেখক-প্রকাশকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রকাশনা শিল্পকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসা, বইমেলার সফল আয়োজন এবং লেখক সৃষ্টিতে প্রকাশকদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সে হিসেবে প্রকাশকরা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে কী মূল্যায়ন পাচ্ছেন, সেটাও ভাবার বিষয়। এই বাংলাবাজারের প্রকাশনালয়ে এমন সব প্রকাশক রয়েছেন, যারা এক জীবনে এই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি অসংখ্য জনপ্রিয় লেখক তৈরি করেছেন। সেসব প্রকাশকের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কোথায়, মূল্যায়ন কি তারা পাচ্ছেন? অন্যপক্ষে বলা প্রয়োজন অনেক প্রকাশকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, তারা বই প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখকের সঙ্গে কোনো চুক্তিপত্র করেন না। বই প্রকাশের প্রকৃত সংখ্যার তথ্য গোপন করেন। লেখককে তার প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী দিতে চান না। লেখকের অনুমতি ছাড়া পুনর্মুদ্রণ বা সংস্করণ প্রকাশ করেন। আবার এমন অভিযোগও আছে যে, লেখকের অনুমতি ছাড়া গ্রন্থস্বত্ব প্রকাশকের নামে নিয়ে যান। শিল্পের স্বার্থে প্রকাশকদের এমন হীনমানসিকতার পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। প্রকাশনা শিল্পের শৃঙ্খলা আনয়নে বাংলা একাডেমির সহায়তা নিয়ে প্রকাশকদেরই ভূমিকা রাখতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close