সোলায়মান মোহাম্মদ
মতামত
এনটিআরসিএর তুঘলকি কান্ড
বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগ সম্পন্ন করে এনটিআরসিএ। এরই ধারাবাহিকতায় গণবিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এ বছরের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে অনলাইনে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষকের শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন কার্যক্রম। সব দলের অংশগ্রহণে সারা দেশ যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়ায় ভাসছে; ঠিক তখনই চলে এ অনলাইনে আবেদন কার্যক্রম। অপপ্রচার ও গুজব বন্ধে অবশ্য বিটিআরসি এ সময় দুই দিন ইন্টারনেট স্পিড কমিয়ে আনে। এক রকম ইন্টারনেটের সঙ্গে যুদ্ধ করেই নিবন্ধনধারীদের আবেদন করতে হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষক নেওয়ার কথা রয়েছে। এনটিআরসিএর তথ্যমতে, সারা দেশ থেকে প্রায় ৩০ লাখ নিবন্ধনধারী আবেদন করেছেন। সে হিসাবে একটি শূন্যপদের বিপরীতে ৭৫ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহেই নির্বাচিত প্রার্থীদের এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে কে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এনটিআরসিএ এ পর্যন্ত ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত একটি নিয়োগ কার্যক্রমও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি বরং এ পর্যন্ত এনটিআরসিএ নামেমাত্র কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। যখন ১-১২তম শিক্ষক নিবন্ধনের সনদের মেয়াদ ২০১৮ সালের পরে মেয়াদোত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়, তখন বঞ্চিত নিবন্ধিত শিক্ষকরা আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রায় ২০০ মামলা করেন। আদালত ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ১৬৬টি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় প্রদান করেন। হাইকোর্ট এনটিআরসিএকে সাতটি নির্দেশনা দেন। ১. এনটিআরসিএ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উদ্দেশ্যে সনদের মেয়াদ নির্ধারণ না করেই সার্টিফিকেট ইস্যু করবে এবং যারা একই উদ্দেশ্যে সনদ অর্জন করবেন তাদের নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সনদের মেয়াদ বহাল থাকবে। ২. এই আদেশপ্রাপ্তির নব্বই দিনের মধ্যে এনটিআরসিএকে একটি মেধাতালিকা করার নির্দেশ করা হচ্ছে এবং এনটিআরসিএর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে আবেদনকারীরা যেন তাদের মেধাতালিকা এবং পজিশন দেখতে পারেন। ৩. শুধু একটি মাত্র মেধাতালিকা থাকবে, এনটিআরসিএ কর্তৃক উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগভিত্তিক কোনো মেধাতালিকা হবে না এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ সম্মিলিত জাতীয় মেধাতালিকা থেকে দেওয়া হবে। ৪. এনটিআরসিএ সর্বশেষ একটি নিয়োগ সম্পন্ন করে বছরে একবার সম্মিলিত মেধাতালিকা আপডেট করবে। ৫. এনটিআরসিএকে জাতীয় মেধাতালিকা অনুসারে রিট পিটিশনার এবং প্রত্যাশিত আবেদনকারীর নাম যাদের সনদ ইস্যু করা হয়েছে, তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এবং নিয়োগের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষা বোর্ড নিয়োগ শিক্ষকদের আবেদনে নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠানে বদলি করার অনুমতি দিতে পারেন। ৬. এনটিআরসিএর শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি যদি কার্যকর না করে তাহলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড ওই কমিটিকে ভেঙে দেবে এবং ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। সর্বশেষ ৭. চাকরির এন্ট্রি প্রসেসে যেহেতু কোনো বয়স নির্ধারণ নেই; সেহেতু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উদ্দেশ্যে প্রার্থীদের বয়সসীমা করতে সরকারের একটি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
আদালত উল্লিখিত সাতটি নির্দেশনার মধ্যে প্রথম এবং প্রধান যে নির্দেশনা; সেটিই কিন্তু এনটিআরসিএ অমান্য করেছে। আদেশ অনুযায়ী প্রথমে ১-১৪তম নিবন্ধিতদের নিয়োগ সুপারিশ সম্পন্ন করার কথা, কিন্তু সেখানে তা না করেই পঞ্চদশ শিক্ষক নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। উপরন্তু ওই বিজ্ঞপ্তিতে বয়স নিয়ে একটি বিভ্রান্তকর তথ্য দিয়েছেন। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রার্থীরা শিক্ষক নিবন্ধনে আবেদনসহ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সনদ অর্জন করবেন, কিন্তু এমপিও নীতিমালা অনুসারে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন কিংবা পরবর্তীতে এমপিওভুক্ত হতে পারবেন না। একজন পঁয়ত্রিশোর্ধŸ প্রার্থী যদি সনদ অর্জন করে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ না পান কিংবা নিয়োগ পেয়েও এমপিওভুক্ত না হন; তাহলে তার এই সনদের কী মূল্য থাকে? শিক্ষক নিবন্ধনের সনদটি মূলত শিক্ষকতা করার একটি পেশাগত সনদ। শিক্ষকতা ছাড়া এ সনদের আর কোনো মূল্যই নেই। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান, দেশি-বিদেশি কোনো কোম্পানি, ফ্যাক্টরি, ফার্ম হাউস এবং এনজিওতে এই সনদ দেখিয়ে চাকরি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি এই সনদ অর্জন করেই বাতিল হয়ে যায়, তাহলে এনটিআরসিএর শিক্ষক নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ আবশ্যক ছিল। কিন্তু তা না করে প্রতিষ্ঠানটি বয়স নিয়ে এ রকম লুকোচুরির মাধ্যমে বেকার যুবকদের সঙ্গে প্রহসনে মেতে উঠেছে। যদি পূর্ণাঙ্গ রায় অনুসরণ করা হয়, তাহলে গণবিজ্ঞপ্তিতে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রার্থীদের আবেদন করার সুযোগ থাকার কথা। সম্প্রতি প্রকাশিত হয় ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধিতদের ফলাফল। তারা এখনো পর্যন্ত সনদ পাননি। কিন্তু এদের মাঝে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব সনদধারীরা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করেই নীতিমালার কারণে বাদ পড়তে হচ্ছে। বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং অমানবিক। হাইকোর্টের নির্দেশিত সাতটি পয়েন্টই অনুসরণীয়। এ সাতটি নির্দেশনার মধ্যে কোনো বিচার প্রার্থী বঞ্চিত হলে তা আদালত অবমাননার পর্যায়েই পড়ে। সে কারণে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব নিবন্ধিত শিক্ষকরা তাদের অধিকার ফিরে পেতে আবারও আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন।
এনটিআরসিএ শিক্ষাব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাতে চায়, তা আমি শত ভেবেও বুঝে উঠছি না। ৪০ হাজার শিক্ষকের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর প্রায় ৩০ লাখ নিবন্ধনধারী ইতোমধ্যে অনলাইনে আবেদন সম্পন্ন করেছেন। এখন শোনা যাচ্ছে, এখানেও না কি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। ৪০ হাজার শিক্ষকের যে শূন্যপদ দেখানো হয়েছে, এটি নাকি সঠিক নয়। গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শূন্যপদের যে চাহিদা চাওয়া হয়েছিল, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান নন-এমপিও ও এমপিও পদগুলোকে গুলিয়ে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, অনেক প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ নেই, কিন্তু ই-রিকুইজিশনে শূন্যপদের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। ফলে বিষয়টি এমন হতে পারে যে, এনটিআরসিএ একজন নিবন্ধনধারীকে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো একটি স্কুলে নির্বাচিত হওয়ায় এসএমএসের মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দিল। নিবন্ধনধারী বেকার ওই যুবক মহাখুশিতে নির্ধারিত ওই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলেন। স্কুলের প্রধান তার স্কুলে শূন্যপদ নেই তাৎক্ষণিকভাবে ওই শিক্ষকের কাছে চেপে গেলেন। কিছুদিন ক্লাস করার পর যখন ওই শিক্ষক জানতে পারলেন যে, এই স্কুলে আদতে তার নির্ধারিত বিষয়ে কোনো শূন্যপদই ছিল না বরং প্রধান শিক্ষক ভুল করে ই-রিকুইজিশনে শূন্যপদের চাহিদা পাঠিয়েছিলেন।
এতকিছুর পরও আমরা আলোকিত ভোরের স্বপ্ন দেখি। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এখানে কেবলমাত্র যোগ্যরাই এনটিআরসিএর সঠিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নির্বাচিত হোক। যেহেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত অভিভাবক হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ডা. দীপু মনি এবং ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল; সেহেতু আমরা চোখ বুঝেই এবার বিশ^াস করতে পারি শিক্ষা খাতে আলো আসবেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"