রেজাউল করিম খোকন

  ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯

অর্থনীতি

ব্যাংক খাতে নতুন প্রত্যাশা

কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে ২০১৮ সাল। অনেক প্রত্যাশা, অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর ২০১৯। দেশের অর্থনীতির স্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে শুরু হলো নতুন বছর। আমাদের রফতানি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, প্রবাসী আয়ও কয়েক বছরের মন্দাভাব কাটিয়ে রীতিমতো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ খুবই ভালো অবস্থায় রয়েছে বর্তমানে। বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে বিপুল পরিমাণে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এবং পরবর্তী সময়ে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্বস্তি দিচ্ছে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের। এমনই এক সুখকর, স্বস্তিদায়ক অবস্থায় দেশে টানা তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। ২০১৮ সালের পুরোটাই ব্যাংক খাতে ছিল নানা অস্থিরতা। তারল্য সংকটের কারণে অনেক ব্যাংকঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছিল। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারেও নানা সংকট ছিল। খেলাপি ঋণেও লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছিল না। শেয়ারবাজার থেকেও ব্যাংকগুলো ভালো মুনাফা করতে পারেনি। তবে আমদানি-রফতানি বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোর ভালো ব্যবসা হয়েছে। বিদায়ী বছরে অর্থাৎ ২০১৮ সালের শেষে দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকে বেড়েছে পরিচালন মুনাফা। বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এবার ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার বড় অংশই এসেছে কমিশন, সার্ভিস চার্জ, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসার আয় থেকে। গেল বছর ব্যাংক খাতে চমৎকার সাফল্যের প্রমাণ দিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংক লিমিটেড। অনেক বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকটি। সোনালী ব্যাংক মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন এক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৮ সালে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ পরিচালন মুনাফা করেছে এ ব্যাংক। যার পরিমাণ ২০৫৮ কোটি টাকা। শুধু মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রেই নয় খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও সোনালী ব্যাংক নতুন রেকর্ড গড়েছে। গেল বছরে এই ব্যাংকের ৩৬৬৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চরম খারাপ সময়ের মধ্যে এটি নিঃসন্দেহে একটি আশা জাগানিয়া ব্যাপার। ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং পরিচালনা পর্ষদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং সঠিক দিকনির্দেশনা বিপর্যয়ের অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল আলোকময় অবস্থানে নিয়ে এসেছে বলা যায়। ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিটেন্সে ঘুরে দাঁড়ানোর বছর ছিল ২০১৮ সাল। সদ্য সমাপ্ত বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১ হাজার ৫৫৭ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে। দেশের ইতিহাসে এক বছরে রেমিট্যান্স আসার এটি একটি অনবদ্য রেকর্ড। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ শতাংশের ওপরে। বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহে ব্যাংকগুলোর তৎপরতা, ডলার পাঠিয়ে ভালো দাম পাওয়া এবং হুন্ডি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপসহ বিভিন্ন ইতিবাচক প্রচারণায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আগ্রাসীভাবে ঋণ প্রদান করার জেরে নগদ টাকার তীব্র সংকটে পড়েছে কয়েকটি ব্যাংক। যে কারণে ব্যাংকগুলোকে এই সংকট কাটাতে তাদের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতে নতুন বছরের প্রথম দিনই কলমানি মার্কেট থেকে ১৮৭১ কোটি টাকা ধার করেছে। ২০১৮ সালে কলমানির ক্ষেত্রে সর্বনি¤œ সুদহার ছিল দেড় শতাংশ। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এটি বেড়ে ৪ শতাংশ দাঁড়ায়।

আমদানি কমায় ২০১৮ সালে স্বস্তি ফিরে এসেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। কিন্তু ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা কাটেনি, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বছরের একেবারে শেষে এসে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবারো পাঁচ বছর দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ‘সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা’ অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের ইশতেহারের মূল কথা। একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোই গেছে। নির্বাচনের বছর ঘিরে অর্থনীতিতে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ছিল। ফের অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধ জ¦ালাও-পোড়াও শুরু হয় কি না, সে শঙ্কাও ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য ও দৃঢ় নেতৃত্বে সবকিছু উৎরে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধির পথেই এগিয়েছে। তারপরেও বলতে হয়, ব্যাংক খাতে ক্রনিক রোগের মতোই খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে। সুশাসনেও ঘাটতি রয়ে গেছে ব্যাংক খাতে। যথেষ্ট সংখ্যক ব্যাংক থাকার পর নতুন আরো কয়েকটি ব্যাংক আসছে, সরকারি অনুমোদন পেয়েছে। নতুন বছরে নতুন সরকারকে এদিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং দেউলিয়া আইন বাস্তবায়নের টেকসই ও কার্যকর পদ্ধতি নির্ণয় করা হবে। বাজার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিচক্ষণতার সঙ্গে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখবে। ঋণ অনুমোদন ও অর্থ ছাড়ে দক্ষতা এবং গ্রাহকের প্রতি ব্যাংকের দায়বদ্ধতা পরিবীক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নেবে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে নতুন সরকারকে শুরু থেকে সাহসের সঙ্গে কয়েকটি কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে যে তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে, সেই তিনটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করলেই বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে তার চেয়েও বেশি গতি সৃষ্টি হবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। জনবান্ধব প্রশাসনের কথা বলা হয়েছে। আর সুশাসন নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে যে আস্থাহীনতা, অনিশ্চয়তা, শঙ্কাবোধ, অস্থিরতাভাব বিরাজমান রয়েছে, এটা সরকারের অর্জিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে যদি ব্যাংকিং খাতে সুশাসন সুনিশ্চিত করা না যায়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে আর্থিক খাতে ফিরিয়ে আনা হবে। আগামী পাঁচ বছর সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি আরো বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে অসাধ্য সাধন করবে। আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে নতুন সরকারের প্রধান কাজ। সরকারের ধারাবাহিকতা থাকার ফলে উন্নয়ন কর্মকা-গুলো ঠিকঠাক মতো চলবে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মতো বৃহৎ উন্নয়ন কর্মযজ্ঞগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির নতুন মাত্রা সংযুক্ত হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ^াস। নতুন বছরে ব্যাংক খাতে তারল্য ব্যবস্থাপনা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। কারণ সঞ্চয়পত্রের সুদ হার অপরিবর্তিত থাকলে আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের

চেয়ে আরো অনেক কমে যেতে পারে। এতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা আরো কমে যাবে। যার বিরূপ প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়তে পারে। অতএব বছরের শুরু থেকে এ বিষয়ে ব্যাংকিং খাতে বিশেষ সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

নতুন বছরে নতুন সরকারের হাত ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু প্রবৃদ্ধিই নয়, অন্যান্য সূচকের ওপরও নির্ভর করে অর্থনৈতিক ভিত্তি। ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকারকে দিতে হবে সর্বোচ্চ নজর। ব্যাংক খাতের সংস্কার ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজস্ব আহরণের গতি বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের কারণে গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক খাতে যে অগ্রগতি হয়েছে, সামাজিক রূপান্তর ঘটেছে, তা আরো শক্তিশালী হবে। বর্তমান সরকারের হাত ধরে অর্থনীতির ভিত হবে আরো মজবুত।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close