শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ

  ১৫ জানুয়ারি, ২০১৯

সম্ভাবনা

বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় রয়েছে সীমাহীন সম্পদ। শুধু আবিষ্কারের অপেক্ষায়। এসব সম্পদে দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে যাবে। উন্নয়নে আরো জোয়ার অনিবার্য। এ ছাড়া খনিজ, জ্বালানি সম্পদ প্রতিনিয়তই জমছে বঙ্গোপসাগরের বুকের ভেতর। রয়েছে ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম। ১৩টি জায়গায় সোনার চেয়ে দামি বালি। যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমানাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট। অগভীরে জমে আছে ‘ক্লে¬’। যার পরিমাণ হিমালয়কেও হার মানায়। যা দিয়ে তৈরি হয় সিমেন্ট। তেল-গ্যাসের সন্ধানও মিলেছে। চেষ্টা করলে তাও আয়ত্তে আসবে। দরকার শুধু তল্লাশি চালিয়ে তুলে আনার। এসব একেবারে স্থায়ী আমানত। খোয়া যাওয়ার ভয় নেই। ব্যাংকে টাকা তোলার মতো বিষয়টা সহজ না হলেও তেমন কঠিনও নয়। প্রযুক্তিগত উদ্যোগটা নিখুঁত হওয়া দরকার।

স্থলভাগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশের জলভাগও। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের অর্থনীতি মূলত তার জলভাগের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ওপরই নির্ভরশীল। এতদিন সীমানা বিরোধের কারণে বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে পারত না বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে। এক বিশাল অঞ্চলজুড়ে (স্থলভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ) বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অঞ্চলে বাংলাদেশ তার সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে পারবে। কিন্তু সে কাজটি খুব সহজ নয়। জলভাগে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালানোর জন্য আর্থিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে যে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকা দরকার ছিল, তার প্রায় কিছুই ছিল না বাংলাদেশের। এখন সেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আশা করা যায়, শিগগিরই বাংলাদেশের অর্থনীতি সাগরে থাকা বিপুলসম্পদকে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে।

বঙ্গোপসাগরের প্রাথমিক সম্পদ হচ্ছে মাছ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ জলসীমায় পাশর্^বর্তী দেশগুলোর মৎস্য শিকারিরা এসে মাছ ধরে নিয়ে যেত। এখন তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। কারণ তারা জেনে গেছে, বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে নির্বিঘেœ ফিরে যাওয়া যাবে না। চৌকস কোস্ট গার্ডের হাতে আটক হতে হবে। সেটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে? কোস্ট গার্ডে জনবল বাড়ানো হয়েছে এবং পাহারা দেওয়ার জন্য বেশকিছু অত্যাধুনিক জাহাজ নামানো হয়েছে। আরো বেশ কিছু জাহাজ সাগরে নামার অপেক্ষায় রয়েছে। নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিন যুক্ত হয়েছে। গ্যাস, খনিজসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি ব্লকে গ্যাস আহরণের জন্য বিদেশি কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। আশা করা যায়, ২০২৫ সালের আগেই সমুদ্রের গ্যাসও বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা যাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের নিজস্ব অনুসন্ধান ও উত্তোলনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ সবই আমাদের আশান্বিত করে। সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখায়।

বাংলাদেশ দুনিয়ার অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। গত চার দশকে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে বসতবাড়ি, স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, শিল্পকলকারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে কৃষিজমি ব্যবহৃত হওয়ায় তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেশে এখন চাষযোগ্য জমির অপ্রতুলতা যেমন দেখা দিচ্ছে তেমন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যাচ্ছে না। সাগরপ্রান্তে জমি উদ্ধার করা সম্ভব হলে এ সংকট থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে। সাগরপ্রান্তে নিঝুম দ্বীপের আশেপাশের জমি উদ্ধার করে বনায়ন এবং পর্যটন জোন গড়ে তোলা হলে পর্যটন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া অবস্থার অবসান ঘটানো সম্ভব হবে। উদ্ধারকৃত জমিতে বনায়ন করা হলে ভূমিক্ষয় যেমন রোধ করা সম্ভব হবে, তেমন উপকূলবর্তী এলাকা ঘূর্ণিঝড় ও টর্নেডোর আঘাত থেকে রক্ষা পাবে।

আরেকটি বিষয় হলো, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশের দাবিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রজয়ে বাংলাদেশ ন্যায্যতার ভিত্তিতে ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক এলাকা ও তদূর্ধ্ব মহীসোপান এলাকা এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রজয়ে বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটারের সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের সঙ্গে যোগ হয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অবস্থিত গ্যাস ব্লকগুলোতে ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার গ্যাসব্লকের ১০টি

ভারত ও ১৮টি মিয়ানমার দাবি করে আসছিল। এ সব ব্লকে বিভিন্ন সময় দেশের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালাতে গেলেও সম্ভব হয়নি। ভারত ও মিয়ানমারের বাধার কারণে ফিরে আসতে হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতের সমুদ্রবিষয়ক রায়ে এ বাধার অবসান ঘটেছে।

ভারতের সঙ্গে আটটি ও মিয়ানমারের সঙ্গে ১৩টি তেল-গ্যাস ব্লক জিতেছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্জিত সমুদ্রসীমায় আনুমানিক ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) আর ভূ-সীমায় মজুদ রয়েছে ১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বর্তমানে প্রতি বছর দেশে এক টিসিএফ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। সে হিসেবে আগামী ১২ বছর পর দেশে গ্যাসের সংকট দেখা দেবে। সমুদ্রসীমায় গ্যাস আবিষ্কৃত হলে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। সাগরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালানোর জন্য আমাদের শুধু অর্থ বা প্রযুক্তির অভাব নয়, দক্ষ জনবলেরও অভাব রয়েছে। সাগরে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার পরিপূর্ণ সুফল পেতে দক্ষ জনবল সৃষ্টির ওপর আমাদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আর এ কাজটি করতে হবে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ও দ্রুত। প্রয়োজনে আমাদের জনবলকে সমুদ্রসম্পদ আহরণে দক্ষ দেশগুলোতে পাঠিয়ে এ কাজে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। তারও আগে সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close