আবু আফজাল সালেহ

  ১৫ জানুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

বিদেশে নারীকর্মী নির্যাতন প্রসঙ্গে

প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে বড় একটা অংশ হচ্ছে নারী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৮৯ জন বাংলাদেশি শ্রম অভিবাসীর মধ্যে ৭ লাখ ২৭৮ জন নারী রয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে নারী শ্রম অভিবাসী ছিলেন ১ লাখ ২১ হাজার ৯৮৫ জন। এর মধ্যে ৮৩ হাজার নারী শ্রমিক সৌদি আরবে। বর্তমানে ২ লাখ ৪ হাজার ৭২৯ জন নারী রয়েছেন সৌদি আরবে। এ সব নারী অভিবাসী উল্লিখিত দেশগুলোতে গৃহকর্মী, হাসপাতাল, পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন কলকারখানায় কর্মরত। পুরুষ কর্মীদের বিদেশে যাওয়া তাদের পরিবার ও সমাজ ভালোভাবে গ্রহণ করলেও নারীরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানান সমস্যার মধ্যে বিদেশে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছেন। বিদেশে অবস্থানরত এই নারী শ্রমিকদের অধিকাংশই যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে নারী নির্যাতনের হার অনেক বেশি। তাদের বৈদ্যুতিক শক, সিগারেটের আগুন দিয়ে ছেঁকাসহ অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়।

২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের লিবিয়ায় পাঠানো বন্ধ থাকলেও সেখানে নারী শ্রমিকদের পাঠানো হচ্ছে। নারী শ্রমিকদের অনেকে আবার আফ্রিকা হয়ে সুদান যাচ্ছেন। তাদের প্রথমে ট্যুরিস্ট ভিসায় সুদানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর সেখান থেকে লিবিয়ায় পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। বিদেশে অবস্থানরত নারী শ্রমিকদের বড় অংশকেই নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। শারীরিক নির্যাতন, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়া, কর্মঘণ্টা বেশি, ফোন ব্যবহারের সুযোগ না থাকার চিত্র প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। বাংলাদেশি নারী কর্মীদের পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কূটনীতি শক্তিশালী নয় বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন। জিরো মাইগ্রেশনে নারী শ্রমিকরা এখন বিদেশ যেতে পারছেন। কিন্তু জিরো মাইগ্রেশনে নারী শ্রমিক পাঠানো সর্বমহলে প্রশংসিত হলেও প্রত্যেক নারী কর্মী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দালালি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারী প্রবাসী শ্রমিকের গুরুত্ব বেড়েছে। মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ করেই শ্রমিক হিসেবে বিদেশে পাড়ি জমানোর সুযোগ পাওয়ায় বর্তমানে দ্রুতগতিতে প্রবাসী নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। অভিবাসী নারী শ্রমিকরা বিদেশের মাটিতে অধিক বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে পরবর্তী সময়ে কম বেতন দেওয়া, ঠিকমতো বেতন না দেওয়া, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে না দেওয়া, পর্যাপ্ত খাবার ও বিশ্রামের সুযোগ না দেওয়া, ওয়ার্ক পারমিট আটকে রাখা, দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য করা এবং দেশে ফিরে আসতে চাইলে স্বজনদের কাছে রিক্রুটিং এজেন্সি বা দালালদের মুক্তিপণ দাবিসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

বাহরাইনের মতো অনেক দেশে যেখানে লেবার অ্যাটাচি নেই সেখানে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের বিপদে পড়তে হচ্ছে। তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েও এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। অন্যদিকে লেবার উইংগুলোতে নারী কর্মকর্তা কম থাকায় নারীরা তাদের সমস্যার কথা ঠিকভাবে বলতেও পারেন না। আর ওমানের অনেক বাড়িতে বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সৌদি, ওমানের গৃহকর্তারা বন্দি শ্রমিকদের ওপর যৌন ও শারীরিক নির্যাতন করছে। বিভিন্ন সূত্রে এ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ভারত নেপাল শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশগুলো প্রবাসী গৃহশ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে অধিক কঠোর। চুক্তিপত্রে যথেষ্ট কঠোরতা

দেখানো হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ

থেকে সৌদি আরব জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী শ্রমিক পাঠানোর হার বেড়ে গেছে। অতএব চুক্তিপত্র ভালোভাবে করতে হবে। সরকার এখন মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ছাড়াও নারী কর্মীদের জন্য নতুন বাজার খুঁঁজছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের চাপ খুব বেশি। সেখানে একেকটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় একেকজন গৃহকর্মীকে রাত দিনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। এদিকে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতিত নারীদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েও দেশে ফিরছেন। জানা যায়, প্রবাসী নারীরা এ সব বিষয়ে নানা অভিযোগ করলেও এগুলোর নিষ্পত্তির সংখ্যা হতাশাজনক।

বিদেশের মাটিতে বিপুল পরিমাণে নারী কর্মী কাজ করলেও তাদের সমস্যা এবং সহযোগিতার জন্য তেমন নেই কোনো শেল্টার হোম, দ্রুত সহযোগিতা পাওয়ার জন্য নেই হটলাইন। অনেক দেশেই নারী কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে সহযোগিতা চাইলেও পাচ্ছেন না। নারী কর্মীদের তাৎক্ষণিক সহযোগিতার জন্য দ্রুত হটলাইন এবং শেল্টার হোম খোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কারণ বিদেশে নারী কর্মীর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, সেই সঙ্গে প্রবাসে নারী কর্মীর সমস্যাও বাড়ছে। বিদেশে নারী শ্রমিক নির্যাতিত হলেও সেখান থেকে অভিযোগগুলো মন্ত্রণালয়ের কাছে আসছে না। এটাও বড় একটা কারণ। অনেকে নারী যৌন হেনস্থা বা নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ করতে বা প্রতিকার পেতে লজ্জাবোধ করেন। তাই বলা যায়, পত্রপত্রিকায় যা প্রকাশ হচ্ছে বাস্তবে নারী নিগ্রহ বা নারী নির্যাতনের হার অনেক বেশি! এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ভাষা সমস্যা। কর্মী সংশ্লিষ্ট দেশের বা ইংরেজি ভাষা না জানার কারণে মালিক-কর্মী ভুল বোঝাবুঝি বেশি হচ্ছে।

কয়েকটা পদক্ষেপ নিলে বিদেশে আমাদের নারী কর্মীদের নির্যাতনের হার কমে যাবে বলে মনে করি। জনশক্তি পাঠানোর সময় ঠিকঠাক চুক্তি করতে হবে। কোনো ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এগুলো কঠোরভাবে দেখভাল করতে পারে। ভাষা সমস্যা সমাধানের জন্য কর্মী পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট দেশের এবং ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। চুক্তিতে উল্লিখিত কাজের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ প্রদান করে কর্মী পাঠাতে হবে। অদক্ষ কর্মী পাঠানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর হার বৃদ্ধি করা যেতে পারে। যেখানে নারী শ্রমিক নির্দ্বিধায় ও খোলাখুলি সমস্যার কথা বলতে পারে। এতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে সরকারের সুবিধা হবে। সমস্যায় সংশ্লিষ্ট নারী কর্মীর পরিচয় গোপন রাখতে হবে। যাতে নির্যাতিত অন্য নারী কর্মীরা পরবর্তী সময়ে নিঃসংকোচে তাদের সমস্যার কথা বলতে পারে।

লেখক : উপপরিচালক (বিআরডিবি), লালমনিরহাট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close