বিশ্বজিত রায়

  ১৪ জানুয়ারি, ২০১৯

স্মরণ

এক নন্দিত নন্দনের প্রস্থান

লাখো মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরশয্যায় শায়িত হলেন রাজনীতির রাজসিক ঘরে জন্ম নেওয়া রাজনীতিশুদ্ধ পুরুষ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। মৃত্যু আনুষ্ঠানিকতার বিশাল জনমোনাজাতের শান্তি স্নান শেষে কবরাকৃত হন রাজনীতিতে নির্মোহ শুদ্ধাচারের নজির সৃষ্টি করা এই নন্দিত নন্দন। রেকর্ড ক্ষমতার দোরগোড়ায় দাঁড়ানো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার দুঃসময়ের সহযাত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে হারিয়ে ধুঁকছে বিষাদের ভীষণ যন্ত্রণায়। দল নিবেদিতপ্রাণ, পরিশুদ্ধ দেশপ্রেমিক, সৎ-নির্লোভ, পরিশীলিত রাজনীতিবিদ তকমাধারী মানুষটিকে হারিয়ে কাঁদছে জনপদ, কাঁদছে রাজনীতি অঙ্গন, ব্যথাব্যথিত কিশোরগঞ্জবাসী। তাঁর এই অসময়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না কেউ। সদ্যপ্রয়াত সৈয়দ আশরাফের নির্মোহ রাজনীতি, ন্যায়নিষ্ঠ শুভ্র জীবনাচরণ ও দেশ দশের প্রতি প্রগাঢ় মমত্ববোধ মানুষের মনমণিকোঠায় গেঁড়েছে স্থায়ী আসন।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রিয় দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অতীতের বহু কণ্ঠকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে যখন সুবিশাল বিজয় অর্জনে ইতিহাস সৃষ্টি করা বর্ণিল পথে হাঁটতে শুরু করেছে তখন ওয়ান-ইলিভেনে শেখ হাসিনার অবর্তমানে অভিভাবকশূন্য দলকে দায়বদ্ধতার দূরদর্শী ডোরে আগলে রেখে যিনি সাহস-সংকল্প-সততায় দলের সজীবতা রক্ষা করতে পেরেছিলেন তিনি আজ অনন্ত পথের পথিক হয়ে চলে গেলেন পরপারে। এ শূন্যতা আশরাফুলপ্রিয় আলয়ে তুলেছে মাতম। আর শেখ হাসিনা তাঁর সুযোগ্য সহচর, বিশুদ্ধ ভরসা বিশ্বাসীজন, আস্থা ও নির্ভরতার নিখাদ প্রতীককে হারিয়ে প্রায় মুমূর্ষু কাতর। পরিচ্ছন্ন প্রয়াত আশরাফুল আওয়ামী লীগের কর্ণধার বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কতটুকু বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন তা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত দুজনের হাত ধরাধরি পরম মিত্রমাখা ছবিটিই হতে পারে তার প্রতীকি রূপ। ফাইল ছবি থেকে প্রকাশ পাওয়া দুজনের র্দুলভ প্রতিকৃতি ক্যাপশনে বলা হয়েছেÑ ‘দলীয় কর্ণধার ধরে আছেন দলের দুঃসময়ের কা-ারির হাত। অপার ভরসায় ধরা সেই হাত আজ চির অধরা। ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে সমাপনী দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফের এই ছবি আজ এক ঐতিহাসিক স্মৃতি। ওই সম্মেলনই ছিল দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফের শেষ সম্মেলন।’

পঞ্চমবারের মতো সদ্য সাংসদ নির্বাচিত সৈয়দ আশরাফ স্পিকার বরাবরে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবেন, নিবেন শপথ। কিন্তু কথা রাখতে পারেননি রাজনীতিতে অনস্বীকার্য অবদানে বাঁধা এই প্রতিভাপ্রতিম রাজনীতিক। নাড়িপোঁতা প্রিয় স্বদেশে ঠিকই ফিরেছেন। তবে কফিনবন্দী নিথর নিস্তব্ধ কান্নার সঙ্গী হয়ে। আশরাফের মরদেহ বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ‘মেঘদূত’ উড়োজাহাজটি মেঘাকাশের তুলতুলে বুক ছিড়ে যখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাটি স্পর্শ করে তখন ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা সোয়া ৬টা। তীব্র কনকনে শীত শোকার্ত পরিবেশে প্রিয় নেতার নিথর দেহখানি উড়োজাহাজ থেকে নামানোর পর চারপাশে বেজে উঠে শোকাবহ করুণ সুর। সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচারে যা ছড়িয়ে যায় সর্বত্র।

কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সদ্যপ্রয়াত সৈয়দ আশরাফ। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অনুপস্থিতিও ঠেকাতে পারেনি সর্বজনপ্রিয় জননন্দিত এই মানুষটির এবারকার বিজয়। সর্বশেষ কিশোরগঞ্জবাসীর দেয়া বিজয় উপহার সঙ্গে নিয়ে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ-ভারতীয় শিলা ঠাকুরের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর স্ত্রী শিলা ঠাকুর মারা যান।

রাজনীতি স্বচ্ছ বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করা হলে সৈয়দ আশরাফ যুক্তরাজ্যে চলে যান। লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাসকালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন এবং যুবলীগের সদস্য হিসেবে লন্ডনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ফেডারেশন অব বাংলাদেশি ইয়ুথ অর্গানাইজেশনের শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে সৈয়দ আশরাফ ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তখন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ফের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৫ সালের ৯ জুলাই তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। এক মাস এক সপ্তাহ দফতরবিহীন মন্ত্রী থাকার পর ১৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের অধীনে রাখা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন তাকে। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল গ্রেফতার হলে সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দলকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রাখেন। একই সঙ্গে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিতাড়নের যে খেলা তখন চলেছিল তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। ওই বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে পরে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর ২০১৬ সালের কাউন্সিলে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীতে নিয়ে যান শেখ হাসিনা।

২০১৬ সালে ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমি সন্তান, আওয়ামী লীগের ঘরেই আমার জন্ম। আওয়ামী লীগ যদি ব্যথা পায়, আমিও বুকে ব্যথা পাই। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী যদি ব্যথা পায় আমারও হৃদয়ে ব্যথা লাগে! আওয়ামী লীগ তো আওয়ামী লীগই, এটা কোনো দল না, আওয়ামী লীগ আমার কাছে একটা অনুভূতির নাম।’ সেই স্বচ্ছ অনুভূতিই তাঁকে দিয়েছে নির্মোহ থাকার রসদ। আজকের আদর্শহীন ভোগ বিলাসিতাপূর্ণ রাজনীতিতে সৈয়দ আশরাফের মতো ত্যাগ-আদর্শিক দিকপাল রাজনীতিকের বড্ড প্রয়োজন ছিল। বর্তমান রাজনীতির রাজকীয় মঞ্চে শত-সহ¯্র রাজনীতিক প্রতিনিয়তই পয়দা হচ্ছে। কিন্তু দেশপ্রেমিক যোগ্য পিতার জ্যোতির্ময় সন্তান পিতৃ আদর্শবাদী সৈয়দ আশরাফের কি জন্ম হচ্ছে। একদম না, বরং হাজারো অযোগ্য লোভ-লালসাগ্রস্ত রাজনীতিকের ভীড়ে অনেকটা অন্তরালেই থেকে যাচ্ছেন নির্লোভ নির্ভেজাল আশরাফেরা। জীবদ্দশায় তাঁদের মূল্যায়ন করতে আমরা অনীহা প্রকাশ করি। মৃত্যুর পর নন্দিত এই মানুষগুলো হয়ে পড়েন সর্বজন গ্রহণযোগ্য স্তুতিধন্য ব্যক্তিত্ব। সততা সুন্দরে সর্বদা জীবন পরিচালনাকারী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বেঁচে থাকাকালীন লোভ নির্লিপ্ত জীবন নিয়ে কি কেউ ভেবেছেন। দেশ ও সমাজের প্রয়োজনীয় কীর্তিগড়া কর্ম সম্পাদন শেষে যখন আশরাফুল ইসলামের মতো কেউ মৃত্যু পালঙ্কে নিথর নিস্তব্ধ শুয়ে থাকেন তখন আমাদের সম্মান, শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত হয়। তাঁর স্তুতিকথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি সকলে। জানাই সহমর্মিতা, আত্মার শান্তি কামনা করি।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যু মহিয়ান বাস্তবতা তেমনি একটি অনুভূতি, যা রাজনীতি ও রাজনীতির বাহিরের মানুষকেও ব্যাপক নাড়া দিতে পেরেছে। রাজনীতিতে অসামান্য অবদান রাখা ভোগ-বিলাসিতাহীন ভালোবাসা রঙে রাঙা রাজনীতির নন্দিত রাজপুত্র সৈয়দ আশরাফের চিরপ্রস্থান এ দেশের রাজনীতি অস্বচ্ছ বর্তমানকে সৎ সততা ও দেশপ্রেমের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে। তারপরও মৃত্যুর ঐ পীঠে রেখে যাওয়া খাঁটি দেশপ্রেমের সজীব রেশ, নীতি-আদর্শে আপসহীন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, জনরায়ের যথোপযুক্ত পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া সুকর্মগুলো দিয়ে যাবে প্রকৃত রাজনীতিক হওয়ার স্বচ্ছ শিক্ষা। এর মাধ্যমে সৈয়দ আশরাফ বেঁচে থাকবেন একজন মৃত্যুঞ্জয়ী প্রথিতযশা রাজনীতিক হিসেবে।

দেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য সন্তান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পিতার দেশপ্রেম ও আদর্শিক চেতনা নিজ সত্ত্বায় ধারণ করতে পেরেছিলেন বলেই মৃত্যুও টলাতে পারছেনা তাঁকে। দেশদ্রোহী নির্মম ঘাতকের বুলেটে পিতার প্রাণ হারানো ক্ষত বক্ষপাঁজরে জিইয়ে রেখেই আমৃত্যু রাজনীতি করেছেন রাজনীতির এই নির্মোহ ক্ষণজন্মা। বর্তমান রাজনীতি থেকে ন্যায়নিষ্ঠ সততা প্রায় বিলুপ্ত হলেও এর যোগ্যতা প্রমাণে লুপ্ত হননি রাজনীতির নির্লোভ প্রতীক সাদামাটা সৈয়দ আশরাফ। তাই পেছন ফেলা রাজনীতি অনিন্দ্য পথের বাঁকে বাঁকে রেখে যাওয়া নিঃস্বার্থ নিদর্শনগুলো তাঁকে পিছু ডাকবে বারেবারে। সৎ-সজ্জন ও বিনয়ী ব্যক্তি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম লোভ-লোলুপতার উচ্চাভিলাষী দুঃস্বপ্ন দূরিয়ে দেশপ্রেমিক পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের ত্যাগ আদর্শকেই শুধু লালন করেননি, রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি বাঁকে চালিয়েছেন এর শুদ্ধ চর্চা। বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে নিজেকে সৃষ্টি করেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী অমূল্য প্রতীকে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close