আবদুল্লাহ আল মাউন

  ১২ জানুয়ারি, ২০১৯

স্বাস্থ্য

পাস্তুরিত দুধ প্রসঙ্গে

আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। শিশুর জন্য পরিবার, শিশুর জন্য সমাজ, শিশুর জন্য রাষ্ট্র সর্বোপরি শিশুর জন্য এই পৃথিবী। যেই শিশুরা আগামী দিনের একটি আদর্শ জাতি গঠনে নেতৃত্ব দেবে সেই শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হচ্ছে আধুনিক বিশে^র বর্তমান এই যুগে। খাদ্যে ভেজাল, যুদ্ধবিগ্রহ, দেশ ত্যাগ, পারিবারিকভাবে হত্যা, অভাব অনটন, হিংসা হানাহানিÑ এসব প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে শিশুরা। অথচ শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠন করার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে ঘটছে সব উল্টো ঘটনা।

বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়টি হচ্ছে ছোট শিশুদের খাদ্যে ভেজাল। বাজারে সরবরাহকৃত খাদ্যদ্রব্যের মান নিয়ে যখন ভোক্তারা চিন্তিত ঠিক এ মুহূর্তে আরো এক উদ্বেগের খবর জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা আইসিডিআরবি। ওই প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণায় জানা যায়, স্থানীয় বাজারে পাওয়া পাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশেরও বেশি বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত। সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা শিশুদের পুষ্টির প্রাথমিক উৎস বাণিজ্যিকভাবে পাস্তুরিত তরল দুধ নিয়ে গবেষণার পর এই ভয়াবহ ও অপ্রীতিকর ফলাফল পেয়েছেন। অথচ সুষ্ঠু ও প্যাকেটজাতের সঠিক নিয়মনীতি অবলম্বন করলে দুধে এই ব্যাকটেরিয়া থাকার কথা নয়।

বর্তমানে আমরা ছাত্রসমাজ, বয়স্ক লোকরাও এই দুধের প্রতি অনেকটা নির্ভরশীল। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দুধ সরাসরি পান করা নিরাপদ জানতে পারায় অনেকেই কাঁচা দুধ পান করে থাকি। এই প্রতিবেদন আমাদের নজরে আসায় বুঝতে আর বাকি রইল না যে শিশুদের পাশাপাশি আমরাও নানাভাবে স্বাস্থ্যঝুঁঁকির মাঝে রয়েছি।

জানা যায়, কেয়ার বাংলাদেশের সহায়তায় ‘স্ট্রেনদেনিং দ্য ডেইরি ভ্যালু চেইন (এসডিভিসি)’ প্রকল্পের আওতায় বগুড়া, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রংপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার মোট ১৮টি উপজেলায় এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এই গবেষণার ফলাফল ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফুড মাইক্রোবায়োলজিতে প্রকাশিত হয়েছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি। গবেষণা প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, দুগ্ধ শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে দুধের অণুজীববিজ্ঞানগত মান যাচাই করার উদ্দেশে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দুধ উৎপাদনকারী, হিমাগার এবং স্থানীয় রেস্তোরাঁ থেকে কাঁচা দুধের ৪৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়াও, ঢাকা এবং বগুড়ার বিভিন্ন দোকান থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকৃত দুধের ৯৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষণাগারে এ সব নমুনা পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে প্রাথমিক দুধ উৎপাদনকারী পর্যায়ে ৭২ শতাংশ ও ৫৭ শতাংশ নমুনাই জীবাণু দ্বারা দূষিত। ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং দুধে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির ফলে বোঝা যায় দুধ জীবাণু বা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা দূষিত, যা উষ্ণ রক্তের প্রাণীর মলে থাকতে পারে বা দুধ দোয়ানোর সময় দুধে মিশতে পারে। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, উৎপাদনকারীদের থেকে দুধ সংগ্রহের স্থানে দেখা যায়, নমুনাসমূহ উচ্চসংখ্যক কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত এবং মল দ্বারা দূষিত হওয়ার হার ছিল ৯১ শতাংশ। এ ছাড়াও ৪০ শতাংশ নমুনায় উচ্চসংখ্যক ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।

পাস্তুরিত দুধ উৎপাদিত হয় আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। ডেইরি শিল্প একটি বাণিজ্যিক শিল্প যার দুধ হতে হবে মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। উন্নত দেশে এই দুধ সরাসরি না ফুটিয়েই পান করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের গবেষকরা দুধ ফুটিয়ে পান করার কথা বলছে কারণ, তা নিরাপদ নয়। দুরারোগ্য হলেও এই কথা সত্য, বর্তমানে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পর্যন্ত নকল করা হয়ে থাকে, ভেজাল সিরাপ খেয়ে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকে, ফলমূলে কার্বাইড মেশানোর ফলে তা মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে সবাইকে।

কিছুদিন আগেও ভেজাল মেশানোর কারণে ১ হাজার মণ আম ও ৪০ মণ খেজুর জব্দ করে নষ্ট করা হয়েছে। সারাদিন রোজা রাখার পর এই খেজুর মানুষ খায়। ফলে অনেকের অসুখও হচ্ছে। ফলমূল, ওষুধ থেকে শুরু করে শিশুদের দুধে পর্যন্ত ভেজালের ছড়াছড়ি। পাস্তুরিকরণ করার পর দুধে ব্যাকটেরিয়া থাকার কথা নয়। পাস্তুরিত দুধের শীতলীকরণ এবং তা নিরবচ্ছিন্নভাবে শীতল রাখার পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে কিনা তার দিকে সরকার যেন নজর দেয় তার দাবি জানাচ্ছি। এমতাবস্থায় সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং কেউ যেন খাদ্যে ভেজাল ও ভেজাল খাদ্য উৎপাদন করতে না পারে সে দিকে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে সবাইকে। তবেই সুখী জীবনযাপন করা সম্ভব।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close