মো. কায়ছার আলী

  ১০ জানুয়ারি, ২০১৯

স্মরণ

মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

‘জয় বাংলা’ আসলেই একটি মন্ত্র। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ বা দাদা ভাই নওরোজীর ‘স্বরাজ’ বা গান্ধীজির ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা নেতাজি সুভাষের ‘চলো দিল্লি’- এ হলো শব্দ ব্রহ্ম। একটি শব্দের বা শব্দের সমষ্টির মধ্যে অসীম শক্তি নিহিত। যে শক্তি অসাধ্যসাধনপটীয়সী। ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ও তেমনি একটি স্লোগান বা চেতনা। যে স্লোগানে একাকার হয়ে মিশে আছে প্রতিটি বাঙালির শিরায় উপশিরায় বা ধমনীতে। এখনো এই শব্দগুচ্ছ শব্দবন্ধ সমগ্র বাঙালিকে একাকার করে দেয়। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের দুঃশাসন, অন্নহীনের হাহাকার, বস্ত্রহীনের সলজ্জ চিৎকার, রুগণের আর্তনাদ, গৃহহীনের ফরিয়াদ এবং নিরক্ষরদের হা-হুতাশ আপামর জনতার করুণ আহাজারি, বুকফাটা কান্না কোনো নেতার কর্ণগোচর হয়নি। দুঃখিত! ভুল বললাম। স্বাধীনতার মহানায়ক তথা ইতিহাসের এক বংশীবাদক বঙ্গবন্ধুর কর্ণকুহরে মানুষের অসীম কষ্ট ও বেদনাগুলো তার মহান হৃদয়কে আলোড়িত করে। সত্তরের দশকের শেষের দিকে তখন বাউলের একতারায় একটি নাম বঙ্গবন্ধু, মাঝির গাওয়া ভাটিয়ালিতে একটি নাম বঙ্গবন্ধু, বস্তাটানা কুলি-মজুরের কণ্ঠেও একটি নাম বঙ্গবন্ধু, কিষাণের ভাওয়াইয়াতেও ফুঠে উঠে একটি নাম বঙ্গবন্ধু। সে কি আলোড়ন, সারা দেশব্যাপী সেকি হিন্দোল, এ যেন ছিল মহাসাগরের উত্থানের মতো চারদিকে ভরপুর বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু। এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তখন জাতীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দু এবং একমাত্র ঐক্যের প্রতীক এ পরিণত হলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠই সমগ্র শক্তির তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী। যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে তরুন যুবকদের বুকে প্রচন্ড আবেগ, উদ্বেগ ও উত্তেজনা, শিশু-কিশোরদের চোখে সীমাহীন কৌতূহল, বয়স্কদের চোখে-মুখে ভীতি, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ, নারীসমাজের বুক অজানা উৎকণ্ঠায় প্রকম্পিত। এমনি পরিস্থতিতে বঙ্গবন্ধু শক্তভাবে দেশের হাল ধরলেন। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে লিঙ্কনের কথা অনিবার্যভাবে প্রাসঙ্গিক। লিঙ্কন দেশ ও জাতিকে চরম সংকট, গৃহযুদ্ধ ও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে অভূতপূর্ব বিজয়ের সম্মান লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার পরই তিনি নিহত হন। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা রূপে স্বাধীনতার ডাক দেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বলেন, দেশের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেন এবং বিশ্বসভায় জন্ম দেন বাংলাদেশ নামক একটি নতুন স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের। কিন্তু তারপর চার বছর না পেরুতেই তিনি নিহত হন। আরো একটি বিস্ময় বঙ্গবন্ধু ও লিঙ্কনকে একই সূত্রে বেঁধে দেয়। লিঙ্কনকে তার বিখ্যাত গেটিসবার্গে ভাষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা কষ্টকর। বঙ্গবন্ধুকে তার ৭ মার্চের ভাষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু একে অপরের সফঙ্গ এমনিভাবে জড়িত যেভাবে গাছ এবং শিকড়, সাগর এবং ঊর্মিমালা, ফুল এবং গন্ধ, আকাশ এবং সূর্য। কারণ এগুলোকে কখনো আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করা যায় না। ২০০৪ সালে আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা তার কন্যা বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার হস্তগত হয়। খাতাগুলো পাঠ করে জানা গেল এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। জেল-জুলুম, নিগ্রহ-নিপীড়ন থাকে সদা তাড়া করে ফিরেছে, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে উৎসর্গীকৃত-প্রাণ, সদাব্যস্ত বঙ্গবন্ধু যে আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন এবং কিছুটা লিখেছেনও এই বইটি তার সাক্ষর বহন করেছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বই, একটি জীবন, একটি ইতিহাস। বইটিকে বলা যায়, বাঙালির ঘরের খোলা জানালা, রৌদ্র করোজ্জ্বল বারান্দা, উন্মুক্ত প্রাণময় উঠোন, বিস্তৃত শ্যামলা শস্যের মাঠ, শত শত ¯্রােতস্বিনী নদী, দূরের মনোমুগ্ধকর সবুজ পাহাড় আর ভালোলাগার বঙ্গোপসাগর। এ বইতে নদী মেঘলা মাটির গন্ধ আছে। মধুমতী নদীর কাদা মাখানো আছে এবং বাইগার নদীর নির্যাস আছে। টুঙ্গিপাড়ানামক অজপাড়াগাঁয়ের আলো-বাতাসের ম-ম ঘ্রাণ আছে। সেই গ্রামে মানবশিশু ছোট্ট খোকার জন্ম ও বেড়ে ওঠার নিবিড় বর্ণনা আছে। যে খোকা নিজেই তার কথা বলেছেন। বলেছেন নিজের ভাষায়, নিজের ভালোবাসায়। স্মৃতি থেকে তুলে এনে জাদুকরী বর্ণনায় সত্যকে সুন্দর করে বলার এক অসম্ভব, অসাধারণ শব্দ গাঁথা এটি। কারাগারের বন্দি জীবনের নির্জন, বন্ধ, প্রকৃতির মায়াহীন, ছায়াহীন ঘরে বসে বেদনার্ত মনে কী করে এমন রূপময় বর্ণনায় বাঙালির মন, রূপ, রস, গন্ধ, আনন্দ, বেদনা আর এই স্নিগ্ধ জননী-জন্মভূমির কথা সহজ সরল ও প্রবহমান ভাষায় নিজের আত্মকথনের মাধ্যমে তুলে ধরলেন, কিছুতেই ভেবে পাই না। এত দিন যাকে জানতাম বাঙালির কান্ডারি, তাকে এখন বইটির মাধ্যমে আবিষ্কার করলাম ইতিহাসের এক রাখাল রাজা, এক অসাধারণ কথক হিসেবে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২৯৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন- ‘This may be my last message, from to-day Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh Wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last, your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved..’ অনুবাদ : এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছো এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এ ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই রাতেই অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। রাত ১টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং এর তিন দিন পর তাকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা। তার আগে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফায়জালাবাদ (লায়ালপুর) জেলে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোনো অধিকার নেই তাকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার উদ্দেশে লন্ডন পাঠানো হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছালে তাকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লাখো জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। পরিশেষে স্বাধীনতা অর্জন এবং মুক্তির লাল সবুজ পতাকা আমাদের এনে দেওয়ার ক্যারিজম্যাটিক নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর মুক্তিকামী বাঙালিদের বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বিজয়ের পরিপূর্ণতা আসে না। তখন এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আসায় ঘরে ঘরে রোজা রেখেছেন, বিশেষ দোয়া এবং প্রার্থনা করেছেন। মানুষের শক্তির কাছে আবার পাকিস্তান সরকার পরাজিত হয়ে মিয়ানওয়ালি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের নিঃসঙ্গ বন্দিজীবন তথা মৃত্যুর মুখ এবং কবরের কাছ থেকে এই দিনে এক মাহেন্দ্রক্ষণে (দুপুর ১টা ৪১ মিনিট) হানাদারমুক্ত পবিত্র মাতৃভূমিতে নেমে বিজয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ আমাদের দিলেন এবং ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close