নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৮ জানুয়ারি, ২০১৯

স্মরণ

দুর্দিনে নৌকার নির্ভীক মাঝি

সৈয়দ আশরাফ বলতেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়; একটি অনুভূতি।’ এই অনুভূতির সঙ্গে সত্যই মিশে আছে বাঙালির ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৬ দফা আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম। মিশে আছে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জয়নুল আবেদীন, মুনির চৌধুরী, জহির রায়হান, জিসিদেব ও শহীদুল্লা কায়সারের আত্মত্যাগের উষ্ণ ও অমর ইতিহাস।

আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদ, বর্তমান প্রেসিডিয়ামের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার শোক বাণীতে বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মতো রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে দেশ ও জাতি আজ মুহ্যমান। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের অত্যন্ত সুযোগ্য ছেলে সৈয়দ আশরাফ ছিলেন পুরোদস্তুর সৎ ব্যক্তি, দক্ষ সংগঠক ও গণমানুষের নেতা। প্রধানমন্ত্রী ১/১১-এর দুঃসময়ে তার বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি আরো বলেন, মানুষের হৃদয়ে এই জননেতা চিরদিন তার কীর্তির মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন। এই আদর্শবান রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ প্রমুখ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। শোক প্রকাশ করেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আওয়ামী লীগের এই সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী বেশ কিছুদিন ধরে ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছিলেন। গত ৩ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে নয়টায় ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে সৈয়দ আশরাফের মেয়ে রীমা ইসলাম, ভাই ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাফায়েতুল ইসলাম, তাদের দুই বোনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা তার পাশে উপস্থিত ছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থাতেই তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে জয়লাভ করেন। তার অনুপস্থিতিতেও এলাকার মানুষ তাকে বিপুল ভোটে জয়ী করেন। এতেই বোঝা যায়, তিনি ছিলেন জনগণের খুব কাছের মানুষ এবং কর্মীদের অত্যন্ত প্রিয় নেতা। গত ৪ ডিসেম্বর, সকালে নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি, ময়মনসিংহ শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। ছাত্র জীবন থেকেই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ওই সময়ে ময়মনসিংহ জেলা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য নাজিমউদ্দিন আহমেদ। সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমদের সঙ্গে ছিল তার ময়মনসিংহের ছাত্র রাজনীতি, আন্দোলন ও সংগ্রামের অম্ল-মধুর স্মৃতি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি মুক্তি বাহিনীর একজন সক্রীয় যোদ্ধা ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর, নির্মম জেল হত্যাকা-ে তার পিতাসহ জাতীয় চার নেতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বুকভরা বেদনা নিয়ে জন্মভূমি ত্যাগ করে যুক্তরাজ্যে গমন করেন এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সে সময় তিনি লন্ডনের বাংলাদেশ যুবলীগের সদস্য হন। লন্ডনে থাকাকালে তিনি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ ইয়ুথ অর্গানাইজেশনের শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৯৬ সালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মাতৃভূমির মাটির টানে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে বেসামরিক পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১-০৫ সাল পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আবদুল জলিল গ্রেফতার হলে, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্ভয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে গঠিত মন্ত্রিসভায় স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৫ সালের ৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দফতরবিহীন মন্ত্রী করেন। এক মাস এক সপ্তাহ দফতরবিহীন মন্ত্রী থাকার পর প্রধানমন্ত্রী তাকে প্রধানমন্ত্রীর নিজের অধীনে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন।

ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ব্রিটিশ ভারতীয় শীলা ঠাকুরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শীলা ঠাকুর লন্ডনে শিক্ষকতা করতেন। ২০১৭ সালেল ২৩ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রিয়তমা পতিœ শীলা ঠাকুরের মৃত্যু তাকে বেদনা বিদ্ধ করে; ভীষণ ব্যথা দেয়। তাদের একটি মেয়ে রয়েছে। সে লন্ডন এইচএসবি ব্যাংকে চাকরি করেন। আশরাফুল ছিলেন শেখ হাসিনার দুঃসময়ের সহযাত্রী। দুর্দিনে নৌকার নির্ভীক মাঝি। একজন নির্ভরযোগ্য ও আস্থাবান মানুষ। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী (২০০৭) আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে জিল্লুর রহমানের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি নির্ভয়ে সাহসের সঙ্গে দলের হাল ধরেন। একই সঙ্গে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিতাড়নের অশুভ খেলার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার এবং সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ এবং সাদা মনের মানুষ হিসেবে তিনি সারা দেশের মানুষ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ত্রিশাল পৌরসভার মেয়র এ বি এম আনিছুজ্জামানের বাবা আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা; মরহুম আবুল হোসেন ও মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলাম একসঙ্গে একসময় ময়মনসিংহের জেলখানায় বন্দি ছিলেন। মেয়র আনিছুজ্জামান তার বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য মাঝেমধ্যে ময়মনসিংহ জেলাখানায় যেতেন, সেখানেই পরিচয় হয় সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে মেয়র আনিছুজ্জামানের কথা-বার্তা ও আলাপ-আলোচনায় তাদের মধ্যে গড়ে উঠে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। নিবিড় সখ্য। সেই সখ্য মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত অক্ষুণœ ছিল। সত্য কথা বলতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখে এই বরেণ্য নেতা ত্রিশাল নজরুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানে তাকে বসিয়ে রেখে পরপর ২০ জন বক্তার বক্তৃতা শুনে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, বর্তমান বিশ্বায়ন ও ডিজিটাল যুগেÑ এভাবে বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে বিরক্ত করা ও মূল্যবান সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

নির্বাচনে আগে শেখ হাসিনা স্বয়ং আশরাফুলের জন্য ভোট চেয়ে ছিলেন কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে। তিনি বলেছিলেন, যেহেতু এখন সৈয়দ আশরাফ সাহেব অসুস্থ, সবাই মিলে তার জন্য কাজ করে যাবেন, যেন তিনি নির্বাচনে জয়ী হন। সুস্থ হয়ে তিনি যেন আমাদের মাঝে ফিরে আসেনÑ এ দোয়া করি। সৈয়দ আশরাফ জয়ী হলেও তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারেননি প্রিয় মাতৃভূমিতে। ফিরে এলো তার কফিন। ফিরে এলো তার সাদা কাপড়ে মোড়া ফুলের পাপড়িতে ঢাকা নিথর-নিষ্প্রাণ দেহ।

ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অসুস্থতার কারণে তিনি গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদ থেকে ছুটি নেন। এই অসুস্থতা নিয়েই এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা, জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন ভীষণ সৎ ও নির্লোভ মানুষ। তার স্ত্রীর অসুখের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নানাজন নানাভাবে তাকে সাহায্য করতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ঢাকা শহরে ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত বাসার সামান্য জায়গাটুকু বিক্রি করে তিনি তার স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ মিটান। তার মতো নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ সত্যই বাংলাদেশে বিরল।

তার বুক ছিল বাংলাদেশের হৃদয়। তিনি ভালোবাসতেন বাংলার মাটি, মানুষ, বঙ্গবন্ধু এবং তার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলামের রেখে যাওয়া নীতি ও আদর্শ। এ আদর্শই তাকে দলের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। করে তোলে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, মহান মানুষ, যা দেশবাসী এবং আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও সমর্থকরা অনন্তকাল ধরে স্মরণ রাখবেন। বর্তমানের এই সর্বগ্রাসী লোভ-লালসা ও নীতি-নৈতিকতাহীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজে সত্যই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব ও অমর ইতিহাস।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close