নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৭ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

এ বিজয় উন্নয়ন অভিযাত্রার

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয় লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও ভাবেননি পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের এত বিশাল বিজয় হবে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী ও কনভেনশন মুসলিম লীগ একটি আসনও পাবে না। ওই নির্বাচনে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা নুরুল আমীন ময়মনসিংহের ত্রিশালের গোহাটা ময়দানের এক বিশাল জনসভায় বলেছিলেন, ‘এক ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তান এসেছে আর এক ভোটের মাধ্যমেই পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হলে মুসলমানদের এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা মাকায় ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।’ জনগণ তার কথা শোনেনি। শুনেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা। বাক্স ভর্তি করে ভোট দিয়েছিলেন নৌকা মার্কায়। ওই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পিডিপির শুধু নূরুল আমীন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মানবেন্দ্র লার্মা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনে তরুণরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। তরুণদের বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার। সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার। বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের পাহাড় সমান বৈষম্য অবসানের। কৃষককে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন পাটের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তির। ওই সময় দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের পেশাই ছিল কৃষি। ওই নির্বাচনে শুধু রাজনীতিবিদরাই নন, দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবীরাও বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির পক্ষে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে। তারপরের ইতিহাস, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং এক কোটি মানুষের দেশ ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধ, ক্ষুদিরামে ফাঁসি, প্রীতিলতা, মাস্টারদা সূর্যসেনের আত্মত্যাগ, সিপাহি বিপ্লব, কৃষক বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ৬ দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থানের এক নিবিড় যুগসূত্র ছিল। ছিল বাঙালির আত্মার সঙ্গে স্বপ্নের সেতুবন্ধ।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে আওয়ামী লীগ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম উচ্চরণ করাও ছিল বড় অপরাধ। শেখ হাসিনা ও তার ছোট রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত লন্ডন ও ভারতের দিল্লিতে অবস্থান করেন তারা। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে তারিখে বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে পা রাখেন। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দলকে সুসংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ নিবেদিত প্রাণ লাখ লাখ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে পেয়ে তিনি বাবা-মা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজন হারানোর দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলে যেতে সক্ষম হন। বাংলার কৃষক, শ্রমিকও মেহনতী মানুষের মধ্যে, বাংলার গাছপালা, নদী-নক্ষত্রের মধ্যে, প্রকৃতি-পরিবেশ, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে খুঁজে পান সূর্যের মতো দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার সাহস। তিনি ও তার দল সামরিক শাসক জিয়া-এরশাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের অংশগ্রহণ করে তিনি বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন হলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০১ সালের প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো হয়। নির্বাচনের পর সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটায় বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। অনেক হিন্দু পরিবারের সদস্য জীবনের ভয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে¡ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে জয় লাভ করে। ক্ষমতা গ্রহণের পর শুরু হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের লালিত স্বপ্ন- সোনার বাংলা বাস্তবায়নের কাজ। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘যে শহীদরা আমাদের হাতে দেশের স্বাধীনতা তুলে দিয়ে গেছে, তাদের মৃত্যু নেই। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন তখনই শুধু এই লাখো শহীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে।’ শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের জন্য রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ গ্রহণ করেন। তিনি জাতির জনকের আদর্শকে ধারণ করে তার চিন্তা, চেতনা, সাহস, শক্তি, যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশকে সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইমেজ এ নির্বাচনকে অনুঘটকের মতো প্রভাবিত করে।

এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট প্রার্থীরা ২৮৮টি আসনে জয় লাভ করে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ, রাজনীতিবিদ ও সুশীলসমাজের সব হিসাব-নিকাশকে ভুল প্রমাণ করেছে নির্বাচনের ফলাফল। এ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যজোট মাত্র ৭টি আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে বিএনপির এই ভরাডুবি দলটিকে ভীষণ সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং গত ১০ বছরের অভাবনীয় উন্নয়ন ভোটারদের নৌকা প্রতীকে ভোট প্রদানে আকৃষ্ট করে।

শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো দেশবাসীকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে চীন, জাপান ও কুরিয়ার মতো একটি উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হন। তার নেতৃত্বে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, নারীর ক্ষমতায়ন ও বিদ্যুৎসহ সব ক্ষেত্রে ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মাথাপিছু বার্ষিক আয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও গড় আয়ু প্রভৃতিসূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সব দেশকে পেছনে ছেলে উল্কার গতিতে এগিয়ে যায়। শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়াই পদ্মা সেতুর মতো একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে চমক লাগিয়ে দেয়। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রেরণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেইন রাস্তা নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল সেতু নির্মাণ, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, ১০০ বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা, দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মতো বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ দেশবাসী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আশান্বিত করে তোলে। আওয়ামীগ সরকার কৃষকের স্বার্থে নন-ইউরিয়া সারের দাম চারবার হ্রাস করে ৮০ টাকা থেকে কমিয়ে টিএসপি সারের দাম ২২ টাকা, এমওপি সারের দাম ৭০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫ টাকা এবং ডিএপি সারের দাম ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ২৫ টাকায় নির্ধারণ করে। ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, উৎপাদনমুখী সরকারি সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে ২ কোটি ৮ লাখ কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি প্রদান। সেচ, সার ও ডিজেলের ওপর ভর্তুকি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক সহায়তা, বিনামূল্যে উপকরণ বিতরণ, আউস ধান ও আখ চাষে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান প্রভৃতি কর্মকা- যেমন একদিকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অন্যদিকে নৌকার বিজয়কেও সুনিশ্চিত করে।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close