সাধন সরকার

  ০৬ জানুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

‘নিষিদ্ধ’ পলিথিন ব্যাগ

পলিথিন ব্যাগ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিÑ এ কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। তার পরও প্রকাশ্যে এর ব্যবহার চলছেই। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে পলিথিন ব্যাগ এবং এটি সহজে বহনযোগ্যও বটে। প্রশ্ন হলো, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ প্রকাশ্যে বিস্তারের দায় কার? জনসাধারণকে এর জন্য দায়ী করা মোটেও সমীচীন হবে না। পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, আমদানি এবং বিক্রয়ের সঙ্গে যারা জড়িত, এ দায় তাদের। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে যারা বা যেসব কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হচ্ছে, এ দায় তাদের। বাজারের দোকানদার বা বিক্রেতা সহজেই ক্রেতার নিত্যপণ্য পলিথিনে ভরে দিচ্ছেন। তা ছাড়া পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে এমন সহজলভ্য ও সস্তা কোনো ব্যাগের সন্ধান জনসাধারণ পর্যায়ে এখনো সেভাবে পৌঁছায়নি! ফলে খোলাখুলিভাবে চলছে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। আমরা পলিথিন ব্যাগকে পরিবেশের শত্রু বলে গণ্য করে থাকি। আর এই শত্রু প্রতিদিন আমাদের ঘরে ঢুকছে। পলিথিন ব্যাগ শহরের জলাবদ্ধতা ও কৃষি জমিতে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। কাগজের ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ কিংবা পাটের ব্যাগ সহজপ্রাপ্য ও কম দাম না হওয়ায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই পরিবেশবান্ধব এই সব ব্যাগ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

অপচনশীল ও ‘অমর’ এই পলিথিন ব্যাগ যেখানে-সেখানে মাটিতে অক্ষত অবস্থায় থেকে এটি মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে ফেলে। এটি শহরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। ফলে পানিদূষণসহ নানা রোগের বিস্তার ঘটছে। ‘পবার’ (পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন) তথ্য মতে, ঢাকায় প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে, যেগুলো একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এক তথ্য মতে, ঢাকার ৮০ শতাংশ জলাবদ্ধতার কারণ পলিথিন। তথ্য মতে, ঢাকায় প্রায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। পলিব্যাগ জমে নগরীর স্যুয়ের, স্টর্ম স্যুয়ের, নালা-নর্দমাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতির কারণ। পলিথিনে খাদ্যদ্রব্য রাখলে তা দ্রুত রাসায়নিক বিষক্রিয়া তৈরি করে। ময়লার ভাগড়ে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে পলিথিন ব্যাগ পোড়ানোর দৃশ্যও চোখে পড়ে। এর ফলে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস নির্গত হয়, যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য রীতিমতো হুমকি। পলিথিন ব্যাগ কোথায় উৎপাদন হয়, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সাথে কারা জড়িত একটু খোঁজ-খবর নিলেই তা জানা অসম্ভব নয়। পরিবেশবাদী সংগঠনের আন্দোলনের মুখে ১৬ বছর আগে অর্থাৎ ২০০২ আইন করে সারা দেশে সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় (তবে রেণু পোনা পরিবহন ও পণ্যের মোড়ক হিসেবে একটু মোটা প্লাস্টিকের মোড়ক বৈধ)। আইন থাকলেও ক্রেতা-বিক্রেতা কারোরই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ফলে পলিথিনের ব্যবহার কখনো থামেনি। পলিথিন ব্যাগের বিস্তার রোধে সবার আগে উৎপাদন কারখানাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। উৎপাদন বন্ধ করলে বিক্রেতা-ক্রেতা পর্যায়ে এগুলো পৌঁছাবে না। সাথে সাথে অন্য পরিবেশবান্ধব ব্যাগ যেমন কাগজের ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ, পাটের ব্যাগ ব্যবহারে জনসাধারণকে সচেতন ও উৎসাহিত করতে হবে।

পরিবেশবান্ধব ব্যাগ বাজারে থাকলেও সস্তায় পলিথিন ব্যাগ পাওয়ার কারণে জনসাধারণ এগুলো ব্যবহার করে না! তাই পাটের ব্যাগের দাম নাগালের মধ্যে আনতে হবে। শুরুতে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে ও জনপ্রিয় করতে দরকার হলে এর ওপর ভর্তুকি দিতে হবে! পরিবেশ অধিদফতর থেকে ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের বিস্তার রোধে মাঝে-মধ্যে অভিযান পরিচালনা হয় সত্য, কিন্তু তা পরিকল্পিত ও নিয়মিত হচ্ছে না বলেই পলিথিন ব্যাগের বিস্তার বাড়ছে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদফতরের। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী, নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের শাস্তি দুই বছরের জেল বা দুই লাখ টাকা জরিমানা। একসঙ্গে দুটি দন্ডও হতে পারে। আবার বিক্রি, প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা ব্যবহারের অপরাধে শাস্তি এক বছরের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা দুটোই। কত সুন্দর ও সময়োপযোগী আইন আছে, অথচ এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। বাস্তবিক পক্ষে এই আইন উৎপাদনকারী, ক্রেতা ও বিক্রেতাদের জানা আছে বলে মনে হয় না! জানা থাকলে আইনের ভয়ে অন্তত প্রকাশ্যে পলিথিনের ব্যবহার করা হতো না! জনসাধারণের মধ্যে পলিথিনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত ও সচেতন করতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের পাশাপাশি সব ধরনের গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা পরিবেশ রক্ষার দায় কারো একার নয়, আমাদের সবার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close