ইয়াসমীন রীমা

  ০৬ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুর কারণ

শীত শুরু হয়ে গেছে। চারিদিকে ম-ম সৌরভ। কিষান-কিষানিরা স্বপ্নে বিভোর। একদিকে ধান কাটা, ঝাড়াই-মাড়াই আর অপরদিকে চলছে আয়েশ করে নবান্নের পিঠাপুলি পায়েস খাওয়ার প্রস্তুতি। এখন গ্রাম-গঞ্জে কৃষিকাজে আধুনিকতা আর যন্ত্রের ব্যবহারের কৃষকদের মধ্যে ফিরে এসেছে গতি। অতিবর্ষণের কারণে এবার কৃষকের আশা উবে গেলেও আমন ধানের বাম্পার ফলনে সেই আশা আবার সঞ্চার হয়েছে। ধান কাটছে কৃষকরা। এ মাসের মধ্যেই কৃষকের সব ধান ঘরে ওঠে আসবে।

কুমিল্লা পশ্চিমের একটি গ্রাম পীরযাত্রাপুর। উপজেলা চান্দিনা। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে ধান ঝাড়াই-মাড়াই হচ্ছে উৎসাহ-উদ্দীপনায়। সর্দার বাড়ির একমাত্র পুত্রবধূ জিনাত আরা ওরফে জিনু এ সময়টায় মহাব্যস্ত থাকার কথা। প্রধানত, গেরাস্থালিনির্ভর তাদের দেড় বিঘা জমির ধান তোলার সব আয়োজন প্রতি বছর সে নিজেই নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু এবার সে ব্যস্ত নয়, অস্থির। দুই মেয়ের পর একমাত্র পুত্রসন্তান তিন মাস বয়সী তওহীদকে নিয়ে। গত দুদিন ধরে সে সারারাত জেগে ছিল। কারণ তার শিশুপুত্রটি জ্বরে পড়েছে। শ্বাসকষ্টে ওর বুকটা ওঠানামা সাথে বাঁশির মতো অদ্ভুত সব শব্দ হচ্ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে তওহীদকে নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়াতে ডাক্তার জানাল শিশুটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সাধারণ সর্দিকাশি ও শ্বাসকষ্ট থেকে অসতর্কতার দারুণ নিউমোনিয়ায় রূপ নিয়েছে। চিকিৎসার পাশাপাশি তার যথেষ্ট পরিমাণ সেবা-যতেœর প্রয়োজন।

প্রতি বছর বিশ্বে ২০ লাখেরও বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আধুনিক চিকিৎসা ও ওষুধপত্রের মাধ্যমে ৮৮টি দেশ এই রোগ নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে। কিন্তু এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ এখনো এই রোগ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। জন্মের এক বছরের মধ্যে বিশ্বে ৮০ লাখ শিশু মৃত্যুবরণ করছে। এর মধ্যে ৫০ লাখ শিশু শিশু জন্মের চার সপ্তাহের মধ্যে মারা যায়। এর ৯৮ ভাগ শিশুই মারা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোয়।

বছরে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী ১ লাখ ৪০ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এই শিশু মৃত্যুর হার গ্রামাঞ্চলে বেশিÑ যেখানে মায়েরা অধিকাংশই অশিক্ষিত। তবে একজন শিক্ষিত মা নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ ও কারণসমূহ সহজে অনুধাবন করতে পারেন বিধায় সময়মতো অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ-চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। পিতা-মাতাকে জানতে হবে শিশুর নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলি কি? শিশুকে কখন ডাক্তারের নিকট নিয়ে যেতে হবে।

নিউমোনিয়া রোগের প্রধান কারণ-ঠান্ডা, পুষ্টিহীনতা, ব্যাকটারিয়া ও ভাইরাস নামক জীবাণু। এর মধ্যে ঠান্ডার কারণে হঠাৎ কর শিশুরা শ্বাকষ্টে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আর লক্ষণসমূহ-ঘন ঘন শ্বাস নেয়া, বুকের নিম্নাংশ শ্বাস নেয়ার সাথে ভিতরে ঢুকে যাওয়া, শ্বাসের সাথে গলায় শব্দ হওয়া, কাঁশি, জ্বর ( অনেক সময় একিউট ব্রঙ্কিউলাইটিস এর জ্বর থাকেনা ) খাওয়ার কষ্ট বা আপত্তি ইত্যাদি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি মিনিটে ০-২ মাস পর্যন্ত বয়সী শিশুর ৬০-বার বা তার চেয়ে বেশি শ্বাস নেয়া এবং ১২ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুর প্রতি মিনিটে ৪০ বার বা তারও বেশি শ্বাস নেয়া অস্বাভাবিক। এ-জাতীয় লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে শিশুকে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। আমাদের দেশে কিছু কুসংস্কার প্রচলিত আছে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেমন : প্রতিদিন শিশুদের গোসল করানো, মাথায় প্রচুর পানিÑ তেল দেয়া, অতিরিক্ত জ্বর হলে মাথায় বনাজি লতাপাতার প্রলেপ দেয়া। নিউমোনিয়া ও অতিরিক্ত জ্বরে শিশুদের খিঁচুনি হতে পারেÑ এটাকে জিনের আছর মনে করা, আবার জন্মের সময় শিশুর মাথায় বেশি চাপ পড়াতে বা জন্মগত কোনো অসুখের কারণে জন্মের পর পর অক্সিজেনের স্বল্পতায় বা ফুসফুসের কার্যক্ষমতার অভাবে শিশু নীল (সায়োনোস্ড) হয়ে পড়ে। এটাকেও জিনের আছরের দোষ বলে থাকেন। গ্রামের কুসংস্কার এবং বহুল প্রচলিত টোটকা চিকিৎসার নামে প্রহসন এ দেশে নবজাতক ও শিশু মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ।

এ ব্যাপারে কুমিলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ইকবাল আনোয়ার বলেন, ‘অজ্ঞতা, কুসংস্কার, গ্রাম্য ঝাড়ফুঁক ও হাতুড়ে ডাক্তাদের দিয়ে চিকিৎসা করানো, দারিদ্র্য এবং হাসপাতালে বিলম্বে আনার জন্য নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। সময়মতো ডাক্তার না দেখানো, শিশু পরিচর্যায় অবহেলা এবং ধর্মীয় গোরামির কারণে মায়েরা রেজিস্টার্ড ডাক্তার ও হাসপাতালে আসে না। ফলে শিশুরা বার্থ অ্যাকফিকসিয়ায় ও নিউমোনিয়ায় ভোগে এবং অকালে মৃত্যুবরণ করে। দারিদ্র্য ও আবহাওয়া পরিবর্তনকে এ জন্যও তিনি দায়ী করেন। শীতের আগমনে সারা দেশে নিউমোনিয়া ও চর্মরোগ দুটি রোগসহ নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি বাড়ছে। ঋতু পরিবর্তনের এ সময়ে ঘরে ঘরে সর্দি, কাশি, ভাইরাসজনিত জ্বর এবং নানা ধরনের চর্মরোগও দেখা দেয়। শিশু-কিশোরদের মধ্যে নিউমোনিয়া ও ব্যঙ্কিউলাইটিস বাড়তে শুরু করে। তবে এখনো গত দুই বছরের মতো ভয়াবহ প্রকোপ দেখা দেয়নি। কিন্তু এক্ষুণি সতর্ক না হলে শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে নিউমোনিয়া রোগ শিশুদের মধ্যে ব্যাপক বিস্তারের আশঙ্কা রয়েছে।’

বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক পালমোলজি ফোরাম প্রধান ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা জানান, ‘সাম্প্রতিক সময়ে শিশুরা যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ব্যাপকহারে আক্রান্ত হচ্ছে, সেটা অনেক ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া নয়; ব্রঙ্কিউলাইটিস। এ রোগ দুটির উপসর্গ প্রায় অভিন্ন হওয়ায় অনেকে রোগ দুটিকে গুলিয়ে ফেলেছে। ফলে ব্রঙ্কিউলাটিস আক্রান্ত শিশুদের নিউমোনিয়া মতো প্রচলিত চিকিৎসা দেয়ার পরও তারা দ্রুত আরোগ্য লাভ করছে না। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে হ্রাস হওয়ায় এবং সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা না হওয়ার কারণে অনেক শিশু মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ছে।’

নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত শিশুর প্রাথমিক অবস্থায় ৩টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবেÑ প্রথমে জ্বর কমান, স্বাভাবিক পানিতে কাপড় ভিজিয়ে ভালোভাবে চিপে সমস্ত দেহ মুছে দিতে হবে এবং জ্বরের ওষুধ প্রয়োগ করে জ্বর কমিয়ে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে রোগীকে সাথে সাথে শিশু রোগ অভিজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হবে, প্রয়োজনবোধে পারেÑ সাকসান মেশিনের সাহায্যে শ্বাসনালির বকেজ মুক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, ভাইরাল নিউমোনিয়াতে প্রাথমিকভাবে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সেকেন্ডারি ইনফেকশন হলে কমবাইন্ড অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয় এবং সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ-ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল কালাম আজাদ অভিমত প্রকাশ করেন, ‘শিশু যদি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে এবং হাসিখুশি থাকে তাহলে বাড়িতে রেখেই আক্রান্ত শিশুকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। কিন্তু যদি শ্বাসকষ্টের কারণে শিশুর খেতে অসুবিধা হয় ও ভীষণ কান্নাকাটি করে তাহলে তাকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। শিশুর অতিরিক্ত কান্নাকাটি রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার লক্ষণ। তবে তিনি আরো বলেন আতঙ্কিত না হয়ে সময়মতো চিকিৎসা করালে শতকরা মাত্র ৫ ভাগ শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয় আর মৃত্যুর আশঙ্কা মাত্র শতকরা একভাগ।

তবে কিছু নিয়ম পালন করে সহজেই শিশুর নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। অর্থাৎ শিশু জন্মের পর থেকে ৫ মাস বয়স পর্যন্ত তাকে বুকের দুধ পান করানো। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু বুকের দুধ পান করে, তাদের তুলনায় সে সমস্ত শিশু অন্য দুধ পান করে তাদের নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও বেশি। বাড়তি খাবার হিসেবে শিশুকে গাঢ় সবুজ বঙের শাক-সবজি ও হলুদ সবজি শিশু-উপযোগী করে খাওয়াতে হবে। শিশুকে সময়মতো সবগুলো টিকা দিতে হবে। টিকা প্রদানের মাধ্যমে শিশুর হুপিং কাশি, যক্ষ্মা, হামসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন কঠিন রোগ থেকে নিরাপদ থাকে। তা ছাড়া শিশুর বাসস্থানের পরিবেশ ধুলাবালি ও ধোঁয়ামুক্ত এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। শীতের সময়টা একটু সতর্ক হলে নিউমোনিয়ার মতো মারাত্মক রোগকে দূরে রাখা সম্ভব।

শিশুর নিরাপদ পরিবেশ, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত প্রতিটি সদস্য দেশ মা ও শিশুর পরিচর্যা ও নিরাপত্তা বিধানে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহ্রাস করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি, ডায়রিয়ার কবল থেকে শিশুকে রক্ষার কর্মসূচি, ধনুষ্টঙ্কারের হাত থেকে শিশু ও মাকে রক্ষার কর্মসূচি, শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। মায়েদের গর্ভকালে রোগ প্রতিরোধ করে নিরাপদ বেঁচে থাকা, শিক্ষা,চিকিৎসা এবং দারিদ্র্যবিমোচনের দ্বারা ২০০৫ সালের ভেতর শিশু মৃত্যুহার ১.১ ভাগ নামিয়ে আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই সবাইকে শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি সতর্কবস্থায় থেকে প্রয়োজনীয় যতœ ও বাড়তি খেয়াল রেখে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি কমানে উচিত।

লেখক : বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close