রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৬ জানুয়ারি, ২০১৯

আন্তর্জাতিক

সুনামির ধ্বংসযজ্ঞে পর্যটনের লীলাভূমি

অপরূপ সৌন্দর্যের দ্বীপ ইন্দোনেশিয়ার বালি। পর্যটক শহর। সমস্ত দ্বীপের মানুষ পর্যটকদের স্বাগত জানাতে আন্তরিক। জনগণ রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের পাতা পর্যন্ত কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলেন। পর্যটকদের অগ্রাধিকার এখানে সবকিছুতে। বসবাসের হোটেল এলাকায় কোনো বাণিজ্যিক দোকান পর্যন্ত নেই। সৈকত এলাকা খুবই পরিচ্ছন্ন। কচ্ছপের এ দ্বীপে আছে বিশাল বিশাল কচ্ছপ। ইন্দোনেশিয়ারাও প্রধানত ভাত আর মাছ খেয়ে থাকে এবং প্রচুর সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়ান রিকশাগুলো আমাদের রিকশার মতো নয়। আমাদের রিকশাগুলো বড় ও সাধারণত ড্রাইভার সামনে থাকেন। ইন্দোনেশিয়ান রিকশাগুলো অনেক ছোট আকৃতির এবং দুই সিটের হয়। তার চেয়েও অদ্ভুত হলো, তাদের রিকশায় যাত্রীদের সিট থাকে সামনে আর ড্রাইভার চালান পেছনে বসে। ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। প্রায় ৫,০০০ দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এই দেশটি পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। এর রাজধানীর নাম জাকার্তা। ১২০০ শতকের দিকে ইন্দোনেশিয়াতে ইসলামের আগমন ঘটে এবং ১৬০০ শতক নাগাদ জাভা ও সুমাত্রার লোকরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। তবে বালি দ্বীপের লোকরা আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু রয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর জাপানিরা ইন্দোনেশিয়া দখল করে।আর্থিকভাবে ইন্দোনেশিয়া এখন বিশ্বের ১৬তম শক্তিশালী রাষ্ট্র।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মতো এত ঘন ঘন বহুতল ভবন নেই। তবে ঢাকার মতো বৃক্ষহীন নয়। সবুজের ছোঁয়া আছে রাস্তার পরতে পরতে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ঢাকার রাস্তার মতো কোথাও ময়লা-নর্দমা দেখা যায়নি। গাড়ি কখনো হর্ন বাজায় না। চালকরা ট্রাফিক সিগন্যালের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সিগন্যালে লালবাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সব গাড়ি থেমে যায়। ইন্দোনেশিয়ানরা অন্তত আমাদের চেয়ে অনেকটা সভ্য জাতি। নিয়মকানুনের প্রতি আমাদের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধাশীল। একটি প্রথা তারা মেনে চলেন, হজ না করা পর্যন্ত ছেলে বা মেয়ে কারো সহজে বিয়ে হয় না। বিয়ের অন্যতম শর্ত থাকে হজব্রত পালন করা হয়েছে কি না। ইন্দোনেশিয়ার বাটিক খুবই প্রসিদ্ধ। ইন্দোনেশিয়ান বাটিকের শার্ট সবারই পছন্দ। ১৯৫০ সালে ইন্দোনেশিয়া জাতিসংঘে ৬০তম সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ইন্দোনেশিয়াতে প্রায় সাড়ে সতেরো হাজার দ্বীপ রয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র ৬ হাজার দ্বীপে মনুষ্য বসতি আছে। সুমাত্রা, জাভা, সুলাওয়েসি, বোর্নিও ও নিউ গিনি পাঁচটি প্রধান দ্বীপ। বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ ইন্দোনেশিয়া। পর্যটন ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস। ইন্দোনেশিয়াতে ৭৪২টি ভাষা আছে। তাদের মধ্যে ৭৩৭টি জীবিত। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় মসজিদের নাম ‘ইসতিকলাল মসজিদ’। ‘ইসতিকলাল’ শব্দের অর্থ স্বাধীনতা। জাকার্তা নগরীতে অবস্থিত ইসতিকলাল মসজিদ মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ। ইসতিকলাল মসজিদের নির্মাণ কার্যক্রম ১৯৫৫ সালেই শুরু হয় এবং ২৯ বছর পর ১৯৮৪ সালে সম্পন্ন হয়।

এ ছাড়া বাংলাদেশের মতো ইন্দোনেশিয়ার বহু অঞ্চল ঘনবসতিপূর্ণ। এর মধ্যে জাভা প্রদেশ ও জাকার্তা নগরী অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। ইসতিকলাল মসজিদটি সাততলার। মসজিদের পার্কিং এরিয়ায় একসঙ্গে ৮০০ গাড়ি রাখা যায়। মসজিদে রয়েছে অতি উচ্চ সুদর্শন একটি মিনার। আশপাশে রয়েছে প্রশস্ত উদ্যান পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জাভা ও সুমাত্রা দ্বীপের মধ্যবর্তী সুন্দা প্রণালির উপকূলে শক্তিশালী সুনামি আঘাত হানে। এই সুনামিতে ২০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। এতে মৃত্যু ছাড়াও এই সুনামির আঘাতে আহত হয়েছেন আরো অন্তত ৮৪৩ জন। ২৮ জন নিখোঁজ রয়েছেন। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটির সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এবারের এই ভয়াবহ ঘটনাটি ভূমিকম্পে নয়, বরং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সাগরতলে ভূমিধসের কারণে সুনামি হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাতে সুনামি আঘাত হানার আগে কোনো রকম সতর্কবার্তা ছিল না। এ কারণে হতাহত বেশি হয়েছে। সুনামিতে কয়েক হাজার ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব তথ্য পর্যেবক্ষণে এটা স্পষ্ট, পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইন্দোনেশিয়ায় আঘাত হানা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রাণ ও সম্পদহানির ঘটনায় আমরা আমাদের গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করছি। এমনটি আশা করতে চাই, ইন্দোনেশিয়ার সরকার ও জনগণ শিগগিরই এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশ্বনেতৃত্বের কর্তব্য হওয়া দরকার, প্রয়োজনে যার যার শক্তি-সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশটির পাশে দাঁড়ানো ও প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার মুখপাত্র সুতোপোপুরও নুগ্রহ টুইটারে সুনামির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও রাস্তায় পানির তোড়ে যানবাহন ভেসে যাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেন। সেখানে ভয়াবহতার চিত্র ফুটে ওঠে। এ ছাড়া একজন রেডক্রস সংস্থার কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে চূর্ণবিচূর্ণ গাড়ি ও মোটরসাইকেলের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বহু বিধ্বস্ত ভবনও দেখতে পাওয়ার কথা বলেছেন। সুনামিতে প্যান্ডেগংল্যাংয়ে যাওয়ার প্রধান সড়কটিও পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুনামির এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রাণহানি ছাড়াও যে সম্পদহানি হয়েছে, তার প্রভাব আমলে নিতে হবে। এ সংকটে ইন্দোনেশিয়ার যেকোনো ধরনের প্রয়োজন হলে বিশ্বসম্প্রদায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে এমনটি প্রত্যাশিত। একই সঙ্গে দেশটির সরকার ও জনগণ সামগ্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথভাবে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা জারি রাখতে সক্ষম হবে এমনটিও আমাদের প্রত্যাশা। সুনামি আঘাত হানার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্রাকাটাও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুপাতের ফলে সমুদ্রের তলদেশে ভূমিধসের সৃষ্টি হয়। এতেই সুনামিটি হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা আবার সুনামির আশঙ্কায় জনগণকে সমুদ্র উপকূল থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।

১৯৪৫ সালে ইন্দোনেশিয়া নেদারল্যান্ডসের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলে ইন্দোনেশীয় ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। ইন্দোনেশিয়ার রেলে ভ্রমণ অনেক সুবিধাজনক ও আরামদায়ক। জাকার্তা শহরে গাড়ির পরিমাণ অনেক বেশি। যারা গিয়েছেন এই শহরটিতে তারাও একে গাড়ির শহর হিসেবে গণ্য করবেন। তবে কোথাও দেখবেন না ফুটপাথে গাড়ি অযথা দাঁড় করানো আছে। তাই গাড়ি যতই থাকুক না কেন, এক এক গন্তব্যের গাড়ি থাকে সাধারণত এক একটি নির্দিষ্ট স্থানে। আর তাদের সাধারণ পাবলিক বাসগুলো সবই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং ব্যবস্থাপনা অনেক ভালো। ইন্দোনেশিয়াতে মেয়েরা সবাই স্কার্ফ পরে থাকে আর বয়স্কদের বেশ পরিমাণে বোরকা পরতে দেখা যায়। ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি আসে ৫.৭৮ শতাংশ, যা ২০০৯ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন আমলে নেওয়া দরকার, জাভার জনপ্রিয় প্যান্ডেগংল্যাং পর্যটক এলাকাতেই প্রায় ১০০ জন সুনামির আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে এখানে আরো বেশি সতর্কতা প্রয়োজন। সর্বোপরি আমরা বলতে চাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারো হাত নেই। এ ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলায় সাধ্যমতো উদ্যোগ অব্যাহত রাখা জরুরি। আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশও একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ।

আমাদেরও মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের জন্য একটি নিয়মিত বাস্তবতা। ভূমিকম্প-ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। ফলে সংশ্লিষ্টদের মনে রাখা দরকার, শক্তিশালী ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা অনেক দেশও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়তি ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে ভ্রমণপিপাসুরা আসে বালি দ্বীপের প্রাকৃতিক রূপে নিজেদের সিক্ত করতে। বালি দ্বীপটি আসলে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এখানে প্রধানত শুষ্ক ও আর্দ্র এই দুটি মৌসুম রয়েছে। তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। ইন্দোনেশিয়া মুসলমান প্রধান দেশ হলেও বালি দ্বীপটি হিন্দুপ্রধান। বালি দ্বীপটিতে পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে প্রচুর পাব, ডিসকো আর নাইট ক্লাব। দ্বীপটি খুবই নিরাপদ। চুরি, ছিনতাই বা কোনো কিছু হারানোর ভয়ই নেই। ইন্দোনেশিয়ার এই দ্বীপে আগে একবার এই অগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নি উৎপাত হয়ে বহু মানুষ আর গ্রাম ধ্বংস হয়েছে।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close