নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৫ জানুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

কৃষির টেকসই উন্নয়নে আধুনিক যন্ত্রপাতির গুরুত্ব

একটা সময় ছিল যখন দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে বর্তমানে সে অবস্থা নেই। এখন দেশের মাত্র শতকরা ৪৮ ভাগ লোক কৃষিকাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বাকি ৫২ ভাগ লোক শিল্প ও সেবা খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্তমানে একজন কৃষিশ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা। অন্যদিকে একজন কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি বা রংমিস্ত্রি দৈনিক মজুরি পান ৫০০ টাকা। একজন রিকশা-ভ্যানচালকও দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা উপার্জন করেন। তাহলে কৃষির মতো এত পরিশ্রমের কাজ কেন করতে যাবে মানুষ? এ দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। কারিগরি শিক্ষায়ও শিক্ষিত হচ্ছে অনেক যুবক। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকরা কৃষির মতো কষ্টের কাজ পছন্দ করে না। তারা কৃষি যন্ত্রপাতি, যানবাহন, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, মোবাইল ফোন মেরামতের মতো অল্প পরিশ্রমের কাজকেই বেশি পছন্দ করে। আজকাল স্বল্প শিক্ষিত লোকজনও কৃষিকাজকে সম্মানের চোখে দেখে না। তারা এটাকে অশিক্ষিত গরিব মানুষের পেশা হিসেবে মনে করে। উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রামে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ফসলের মাঠে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। তারা ধান রোপণ, ধান কাটা, ধান মাড়াই, আখ রোপণ, আগাছা দমন, আখ কাটা, আখ বাঁধা, ভুট্টা রোপণ, আলু রোপণ, আলু তোলা, ভুট্টা মাড়াইসহ এমন কোনো কৃষিকাজ নেই, যা পারেন না। বিভিন্ন রকম শাকসবজি রোপণ, পরিচর্যা ও উত্তোলন কাজেও এসব নারী শ্রমিকদের দক্ষতার তুলনা হয় না। অনেকে পাট থেকে আঁশ ছড়ানো, আখ ও খেজুর রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজও করেন। চালের চাতালেও কাজ করেন অনেক নারী শ্রমিক। উত্তরাঞ্চলে নারী শ্রমিকরা কৃষিকাজ না করলে সেখানে শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষিকাজ বিঘিœত হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অনেক সময় ধান রোপণ বা ধান কাটার মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়। তখন শ্রমিকের মজুরি অনেক বেড়ে য়ায়। ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। অনেক সময় কৃষি শ্রমিকের অভাবে সময় মতো ফসল রোপণ, পরিচর্যা করা যায় না। ফলে প্রত্যাশিত ফলন থেকে কৃষক বঞ্চিত হন। আজ থেকে ২০ বছর আগেও একজন কৃষি শ্রমিক সকাল ৮টায় এসে কাজ শুরু করতেন এবং মাগরিবের নামাজের আগ পর্যন্ত কাজ করতেন। এখন তারা সকাল ৯টায় এসে কাজ শুরু করেন এবং জোহরের নামাজের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শেষ করে বাড়ি চলে যান। এতে দেখা যায় একজন কৃষিশ্রমিক দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন না। শ্রমিক সংকটের কারণে বেশি জমির মালিকরা এখন আর কোনো কৃষি কাজই করেন না। তারা বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে জমি লিজ দিয়ে সন্তান-সন্ততি নিয়ে শহরে বসবাস করেন। যারা নিজেরা জমিতে কাজ করতে পারেন, বর্তমানে তারাই শুধু কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কারণ শ্রমিক দিয়ে সব কাজ করে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে আসল টাকাও ঘরে তোলা যায় না। এ জন্য কৃষিকাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে। এসব কারণে অনেকে কৃষিকাজ ছেড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গো-পালনের মতো পেশায় ঝুঁকছেন। এ অবস্থায় কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে হলে কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই সম্প্রতি (১০.২.১৮) রাজধানী ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হলো তিন দিনব্যাপী জাতীয় কৃষি যন্ত্রপাতি মেলা। মেলায় সরকারি ও বেসরকারি মিলে ২১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জাতীয় কৃষি যন্ত্রপাতি মেলার বিশেষ কয়েকটি আকর্ষণের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ‘সবজি ধৌতকরণ যন্ত্র’টি ছিল অন্যতম। যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেন, ওই প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর নূরুল হক। তার উদ্ভাবিত এ যন্ত্র দিয়ে গাজর, মুলা ও কচুর মতো মাটির নিচের সবজিগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় সহজে। ঈশ্বরদী, পাবনা, ঢাকা ও সাভারে বেশি গাজর উৎপন্ন হয়। কৃষক উৎপাদিত গাজর হাত ও পায়ের সাহায্যে ঘষে পরিষ্কার ও চকচকে করেন। এতে কৃষকের খুব কষ্ট হয়। বেশি সময় ও অর্থের অপচয় হয়। অনেক সময় গাজর পরিষ্কারকালে কৃষকের হাতে-পায়ে ফুসকা পড়ে। প্রচলিত পদ্ধতিতে হাত-পায়ে ঘষে গাজর পরিষ্কারে কৃষকের প্রতি কেজিতে যেখানে খরচ হয় ৮০ পয়সা, সেখানে এই যন্ত্র দিয়ে পরিষ্কারে প্রতি কেজিতে খরচ হয় মাত্র ২৫ পয়সা। এতে কৃষকের প্রতি কেজিতে ৫৫ পয়সা বেঁচে যায় অর্থাৎ ৬৬ ভাগ অর্থ সাশ্রয় হয়। এ ছাড়া স্বল্প সময়ে জমি তৈরি করে ফসল চাষের জন্য হাইস্পিড রোটারি টিলার, বীজ বপন যন্ত্র, নালা তৈরির জন্য বারি ব্লেড প্লান্টার, বারি গুঁটি ইউরিয়া প্রয়োগযন্ত্র, বারি শুকনা জমি নিড়ানি যন্ত্র, বারি শস্য কর্তন যন্ত্র, বারি শস্য মাড়াই যন্ত্র, হস্তচালিত ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, আলু উত্তোলন যন্ত্র, শস্য ঝাড়াই যন্ত্র, আমপাড়া যন্ত্র, ফল শোধন যন্ত্র, হাইব্রিড ডায়ার, কমপোস্ট সেপারেটরসহ মোট ৩৯টি নিজস্ব উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত শস্য মাড়াইয়ের জন্য ‘ওপেন ড্রাম থ্রেসার’ যন্ত্রটিও দর্শকদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ যন্ত্রটি শস্যের মাড়াইকালীন অপচয়, কমানো, ব্যয় ও শ্রম কমানো, মাড়াই দক্ষতা ও ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে উদ্ভাবন ও প্রদর্শন করা হয়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাটের ফলন বৃদ্ধির জন্য এবং কৃষকের কল্যাণে ৯টি কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবন করে। যন্ত্রগুলো এখনো প্রান্তিক কৃষকদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে অচিরেই পাট চাষিদের হাতেনাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে যন্ত্রগুলো তাদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাদেশ সুগার ক্রপ রিসার্স ইনস্টিটিউট মেলায় ৫টি কৃষিযন্ত্র প্রদর্শন করে। যন্ত্রগুলো হলোÑ কম চাষে আখের নালা তৈরির যন্ত্র, আগাছা নিড়ানি যন্ত্র, আখের চোখ তোলার যন্ত্র, আখের বীজখ- তৈরির যন্ত্র ও বর্জ্য পানি পরিশোধন করে সেচ কাজে ব্যবহারের যন্ত্র। যন্ত্রগুলো আখচাষিদের মধ্যে এখনো ব্যাপকভাবে ব্যবহার না হলেও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের বাণিজ্যিক খামারগুলোতে এসব যন্ত্রপাতির কয়েকটি ব্যবহার হচ্ছে। মেলায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ২৬ প্রকার কৃষিযন্ত্র প্রদর্শন করে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মেলায় বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি মেলায় প্রদর্শন করে। এসব প্রতিষ্ঠানে মধ্যে রয়েছে- সিমিট বাংলাদেশ, আইডিই বাংলাদেশ, চিটাগাং বিল্ডার্স অ্যান্ড মেশিনারি লিমিটেড, আলিম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং, এসিআই লি. ও হক করপোরেশন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চিটাগাং বিল্ডার্স অ্যান্ড মেশিনারি লিমিটেড মেলায় ৩০টির ও অধিক কৃষি যন্ত্রপাতি প্রদর্শন করে। প্রতিষ্ঠানটির তৈরিকৃত প্রায় সব কৃষি যন্ত্রগুলোই কৃষকের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এবারের মেলায় ওই প্রতিষ্ঠানটির নতুন সংযোজন হলো কম্বাইন হার্ভেস্টার। অপরদিকে হক করপোরেশন নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতি দেশের বাজারেই বিক্রি করছে না, বিদেশেও রফতানি করছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত প্রায় ২০০টির অধিক কৃষি যন্ত্রপাতি বিদেশে রফতানি করে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি সাধারণত ভারত, কেনিয়া, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া, মিয়ানমার ও তানজিনিয়াতে সুনামের সঙ্গে কৃষি যন্ত্রপাতি রফতানি করছে।

দেশের বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন হচ্ছে, কৃষকের মাঠে সে পরিমাণে যন্ত্রপাতিগুলোর ব্যবহার দৃশ্যমান হচ্ছে না। এর কারণ হতে পারে যন্ত্রগুলোর ব্যবহার কৃষক জানেন না অথবা যন্ত্রগুলো কৃষকের কাছে সহজলভ্য নয়। মাঠপর্যায়ে উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতিগুলোর ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষিকে লাভজনক করতে হলে প্রত্যেক উপজেলা ও ইউনিয়নে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর হাতেনাতে চাষি প্রশিক্ষণ ও পদ্ধতি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে। সুলভ মূল্যে ও সহজে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। যন্ত্রপাতিগুলো বাংলাদেশে মাটি, আবহাওয়া, ফসল এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য উপযোগী হতে হবে। যন্ত্রপাতিগুলোর দাম কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকতে হবে এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী হতে হবে। যন্ত্রপাতিগুলো যাতে কৃষক সহজে চালাতে পারে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এসব ব্যাপারে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এবং যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় আরো জোরদার করতে হবে। আর কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সরকার কৃষকদের যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে কৃষিকে কোনো অবস্থাতেই লাভজনক, আকর্ষণীয় ও টেকসই করা যাবে না।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close