দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

বিস্ময়কর বাংলাদেশ

বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার বিস্ময়। এশিয়া এমনকি বিশ্ব পরিসরেও এ অভিধাটি প্রযোজ্য। মুক্তিযুদ্ধে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে যে তা-ব চালায় তার কোনো তুলনা নেই। ভিয়েতনামে মার্কিন হানাদাররা বছরের পর বছর ধরে বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও মাত্র ৯ মাসে পাকিস্তানি সেনাদের তা-ব তার চেয়েও ভয়াবহ। এক কোটি মানুষের দেশত্যাগ, ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানি, দুই থেকে তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি ছিল পাকিস্তানি বর্বরতার উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের কয়েক লাখ বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা। স্বাধীনতার পর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার অবজ্ঞা করে বাংলাদেশকে অভিহিত করেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’।

স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রথম যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সেখানে বলা হয়, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম।’ নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফ্যালান্ড এবং ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে আর পারকিনশন মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, যদি এই দেশটি উন্নতি করতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, পৃথিবীর যে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারবে।’ স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর আমলে ‘চারদিকের নেই নেই’র সেই কঠিন দিনগুলোতেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল সাত শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামাতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা ছিল খুনি চক্রের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৯১ সালে দেশে দৃশ্যত গণতান্ত্রিক শাসন চালু হলেও ১৯৯৫ পর্যন্ত তাদের প্রভাবই বজায় থাকে। ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে শুরু হয় উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলা। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হয় সে আমলে। তারপর ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কল্পকথার ভূতের মতো পেছনে চলা।

২০০৯ সালে সে বৃত্ত থেকে মুক্তি পায় বাংলাদেশ। তার পরের ইতিহাস শুধুই এগিয়ে চলার। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, একের পর এক অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া শুধু নয়, বিশ্বের অন্যতম উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। মানবসম্পদ উন্নয়নে ভারতও বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে। স্বাধীনতার এ অর্জন যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে।

অকপটে স্বীকার করতে হবে যে, বাঙালির এই অর্জন কোনো অংশেই কম নয়, বরং নিয়মিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানব উন্নয়ন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাদ্য উৎপাদন, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, শান্তি-শৃঙ্খলা সবকিছুতেই এবং সব সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তানের চেয়ে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ভাষায়, দেশটি এখন বৈশ্বিক মানচিত্রে উন্নয়নের রোল মডেল। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এমনকি পাকিস্তানও এখন অনুসরণ ও অনুকরণ করতে পারে বাংলাদেশকে। বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে পাকিস্তানকে। ২০১৭-এর জুনে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৫৩৮ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানের এক হাজার ৪৭০ ডলার। বাংলাদেশের চেয়ে ৬৮ ডলার কম। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় আরো বেড়েছে। বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। গত তিন বছরে তা ছাড়িয়ে গেছে ৭ শতাংশের ওপরে। অচিরেই তা ৮ ও ততোধিক হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা ২০২১ সাল নাগাদ তা ১০ শতাংশে উন্নীত করা। আর পাকিস্তানের জাতীয় প্রবৃদ্ধি আটকে আছে ৬-৭ শতাংশের নিচে। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য আসলেই ঈর্ষণীয়। পাকিস্তান ও ভারত মিলে বিশ্ববাজারে যে পরিমাণ গার্মেন্ট সামগ্রী রফতানি করে, বাংলাদেশ একাই রফতানি করে থাকে তার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪ শতাংশ। পাকিস্তানে ২.৪ শতাংশ। আর্থ-সামাজিক প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়ে পাকিস্তানের চেয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৬ বছর। পাকিস্তানের ৬৬ বছর। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩১, পাকিস্তানে ৬৬। বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষার হার ৪২ শতাংশ। পাকিস্তানে তা অর্ধেকেরও কম ২০ শতাংশ। শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ। এই তালিকায় ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম, পাকিস্তানের অবস্থান ১৫৩তম। আর ভারতের ১৪১তম। তদুপরি পাকিস্তান বর্তমানে জর্জরিত ধর্মীয় মৌলবাদ, কূপমন্ডূকতা, জাতিগত বিদ্বেষ, তালেবান, আইএস, জইশ-ই মোহাম্মদসহ অসংখ্য জঙ্গিগোষ্ঠী ও উপজাতি দ্বন্দ্ব-সংঘাত-হানাহানি ও রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে। বিশ্বে পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে সুপরিচিত।

তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক আর্থিক ঋণ প্রত্যাহৃত হওয়ার পর বাংলাদেশ চীনের সহায়তায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে স্ব-উদ্যোগে ও স্ব-অর্থায়নে। রূপপুরে রাশিয়ার সহযোগিতায় নির্মাণ করছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। অন্যদিকে ক্রমাগত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে পাকিস্তানের অর্থনীতি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ভগ্নদশাপ্রাপ্ত, দেউলিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে তারা পাকিস্তানকে আর এক ডলারও সাহায্য দেবে না। চীনের ঋণেও পাকিস্তান আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। আর তাই সেনাবাহিনীর সহায়তায় নবনির্বাচিত সরকারপ্রধানকে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ছুটতে হয়েছে সৌদি আরবে। সে অবস্থায় পাকিস্তান যদি অচিরেই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ও পরিগণিত হয় বিশ্ব মানচিত্রে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close