সাধন সরকার

  ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ

দেশে দেশে দূষণ ভয়াবহ মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দূষণ (বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ, মাটিদূষণ, পানিদূষণ, বর্জ্যদূষণ) নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সে ধরনের যথাযথ ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে দেশগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, ‘উন্নয়ন’ ও ‘পরিবেশ রক্ষা’ দুটি বিপরীত শব্দ। উন্নয়ন করতে গেলে পরিবেশের ক্ষতি হবেই। ফলে বিশে^র উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে দূষণ বেশি! তবে সিঙ্গাপুর, নেপাল, শ্রীলংকা, লাওস, ভুটান, ইন্দোনেশিয়ার মতো অনেক দেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক উন্নতি করেছে। তবে পৃথিবীব্যাপী এখন দূষণকে দেখা হচ্ছে ‘বিপর্যয়’ হিসেবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদন মতে, বিশে^ প্রতি চারজনের মধ্যে অন্তত একজনের মৃত্যু হয় পরিবেশগত দূষণের কারণে। সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে বায়ুদূষণে মারা যায় প্রায় ৪২ লাখ মানুষ। বিশ^ব্যাংকের সম্প্রতি এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ক্ষতি হয় প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা (যা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩ ভাগ)। আর দূষণের কারণে ২০১৫ সালেই শহরাঞ্চলে মারা গেছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। বাংলাদেশে শহরের শিশুদের একটা বড় অংশ বায়ুদূষণের শিকার। জাতিসংঘের এক তথ্য মতে, ২০১৬ সালেই শুধু বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশে^ ৫ লাখের বেশি শিশু (৫ বছরের নিচে) মারা গেছে। কোপেনহেগেনভিত্তিক ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির (ইইএ) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণ একটি ‘অদৃশ্য ঘাতক’। শুধু ইউরোপে প্রতি বছর বায়ুদূষণে মৃত্যু ঘটে প্রায় ৫ লাখ মানুষের। মূলত বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তু কণা পিএম বা পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫-এর পরিমাণ যত বেশি সে শহর তত বেশি দূষণে জর্জরিত (যদিও পিএম ২.৫-এর মাত্রা ২০-এর বেশি হওয়া উচিত নয়)। বড় শহরগুলোয় ‘পিএম ২.৫’ দূষণের কারণে মানুষের ফুসফুস থেকে দূষিত বায়ু সরাসরি রক্তে প্রবেশ করছে। দূষণের কারণে শ^াস-প্রশ^াসজনিত সমস্যা, হাঁপানির সমস্যা, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশুরা। তথ্য মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত ২০টি শহরের তালিকায় ভারতেরই শুধু ১৪টি! বায়ুদূষণ রোধে নিষ্ক্রিয়তার জন্য ভারতের কলকাতা ও হাওড়া রাজ্য সরকারকে পাঁচ কোটি করে জরিমানা করেছেন জাতীয় পরিবেশ আদালত।

প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ সারা পৃথিবীতেই ভয়াবহ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণে জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতির আশষ্কা করা হচ্ছে। সমুদ্রে তিমি মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর পেটে যাচ্ছে প্লাস্টিক। প্লাস্টিক ও পলিথিনের রয়েছে ‘অনন্ত আয়ু’। এক প্রকার ‘অমর’ পরিবেশের এই ক্ষতিকারক সামগ্রী নিয়ে দেশে দেশে চিন্তার শেষ নেই। প্লাস্টিক ও পলিথিন পুড়িয়ে ফেললেও তা থেকে বের হওয়া হাইড্রো-কার্বন পরিবেশের দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্লাস্টিক ও পলিথিন দ্রব্যের ব্যবহার কমাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এখন এসব পণ্যের ওপর কর বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি কাগজের ব্যাগ অথবা বারবার ব্যবহার করা যায় এমন ব্যাগের ওপর গুরুত্বারোপ করছে। এ ছাড়া প্লাস্টিকের রিসাইক্লিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় প্লাস্টিক দূষণ ঠেকাতে জনগণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সেখানকার একটি অঞ্চলে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার বদলে গণপরিবহনে বিনা ভাড়ায় কয়েক কিলোমিটার চড়তে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তথ্য মতে, প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। তাই পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই প্লাস্টিক ও পলিথিনের বিকল্প ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশে^র অন্যতম দূষিত শহর বেইজিং বায়ুদূষণ রোধে ইতোমধ্যে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। বেইজিং শহরের রাস্তা থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি তুলে নেওয়া হয়েছে। এর বদলে জনগণকে সরকারের ব্যবস্থা করা গাড়িতেই চলাচল করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া চীন বায়ুদূষণের প্রভাব নির্ণয়ে জাতীয় নেটওয়ার্ক স্থাপন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। ‘পিএম ২.৫’ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে এই নেটওয়ার্ক। কোনো কোনো দেশ, বড় বড় সংস্থা ও শিল্পকারখানার তরফ থেকে কোনো কোনো সময় দূষণের ব্যাপারে তথ্য গোপন করা হয়। এর ফলে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দূষণ নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর না দিয়ে শুধু উন্নয়ন আর শিল্পায়ন করলে পরিবেশ দূষণের কবল থেকে যে রেহাই পাওয়া যায় না, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন ভারতের বহু রাজ্যের শহরবাসী ও শিল্পপতিরা। শিল্পপতিদের শিল্পায়নের সাথে সাথে দূষণ নিয়ন্ত্রণের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। জাপান শিল্প বিনিয়োগের প্রায় ২৫ ভাগ অর্থ পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যয় করে।

পরিরেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে অজীব ও জীব প্রতিটি উপাদানই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভৌতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক কারণে যেকোনো একটি উপাদানের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলে সামগ্রিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পায়। সার্বিক বিচারে এখন উন্নয়ন ও শিল্পায়ন করার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা তথা দূষণ রোধে জোর দিতে হবে। দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিশ^ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৫ সালেই রাজধানী ঢাকায় শুধু বায়ুদূষণে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখন সময় হয়েছে বিশে^র অন্যতম পরিবেশ দূষণকারী দেশ (বাংলাদেশ) হিসেবে দূষণ রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার। গৃহস্থালি বায়ুদূষণও বেড়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে দূষণমুক্ত জ্বালানি এবং সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। প্রশ্ন হলো, বিশে^র অন্যতম পাট উৎপাদনকারী দেশ হয়েও বাংলাদেশ কেন নিষিদ্ধ ও পরিবেশের শত্রু পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক ও জনবান্ধব করতে পারছে না? দরকার হলে পলিথিন ব্যাগের ওপর বেশি কর বসিয়ে সেই করের টাকা পাটের ব্যাগের ওপর ভর্তুকি দিয়ে পাটের ব্যাগের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হয়েও তা দেদার চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্লাস্টিকসামগ্রীর উৎপাদন ও চাহিদা দিন দিন বাড়বে! তাই এর ব্যবহার কমাতে যতটা সম্ভব এর ওপরও কর বৃদ্ধি করার পাশাপাশি রিসাইক্লিংয়ের ওপর জোর দিতে হবে। যদিও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করে থাকে এমন হাজার হাজার ভাঙারির দোকান গড়ে উঠেছে। এসব ভাঙারির দোকানগুলো থেকে প্লাস্টিকের বোতল কিনে নেন প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকরা। পরে এই প্লাস্টিকের বোতল কুচি কুচি করে বিদেশে রফতানি করা হয়। তাই প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণ কারখানা শিল্পের বিকাশে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া দূষণ নিয়ন্ত্রণে শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও ডিজেলচালিত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি পর্যাপ্ত গণপরিবহনের সুব্যবস্থা রাখতে হবে। শহরে চলাচলের ক্ষেত্রে হাঁটা ও সাইকেল ব্যবহারের ওপর জনসাধারণকে উৎসাহিত করতে হবে। যাতায়াতে শহরগুলোয় মেট্রোরেলের ব্যবস্থা করতে হবে। দূষণ রোধসহ সার্বিক পরিবেশ রক্ষার্থে গাছ লাগানোর ওপর জোর দিতে হবে। কেননা বৃক্ষরাজি কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণসহ শব্দদূষণও রোধ করতে পারে। প্রত্যেকটি শিল্পকারখানায় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। ট্যানারিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার বর্জ্য ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য খাল-বিল ও নদীর সাথে ফসলি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে মাটি দূষণ করে থাকে। আবার কোনো কোনো এলাকায় আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করার ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এ ব্যাপারে জনসাধারণ পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। শব্দদূষণ ঠেকাতে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ¦ালানির ওপর জোর দিতে হবে। ইলেকট্রনিক দূষণ ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। এই দূষণ রোধে বিশ^ব্যাপী জোর দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশকেও ফেলে দেওয়া বা ব্যবহার করা ইলেকট্রনিকস বা ডিজিটাল যন্ত্রপাতির দূষণ রোধে বিভিন্ন কোম্পানির সাথে চুক্তি করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্জ্যরে দূষণ রোধে নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য ফেলার ওপর গুরুত্বারোপ ও রিসাইক্লিংয়ের ওপর জোর দিতে হবে। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে ইটভাটার আধুনিকায়ন করতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার বাড়াতে হবে। সব ধরনের দূষণ মোকাবিলায় পরিবেশ অধিদফতরকে ঢেলে সাজানোসহ জনবল বাড়াতে হবে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যথাযথ পরিবেশ আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ বেশির ভাগ সময় দেখা যায় না বা করা হয় না! সার্বিক পরিবেশ রক্ষার্থে তথা দূষণ রোধে পরিবেশের সব আইন ও বিধিমালার কার্যকর প্রয়োগ হলে দূষণ কমবে বলে মনে করি। পরিবেশ দূষণের দায়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ছাড় দিলে চলবে না। সহজ কথায়, আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও জরুরি। এ কথা মনে রাখতে হবে, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে পরিবেশ রক্ষা করেই এগিয়ে যেতে হবে। নতুবা পরিবেশ ধ্বংস করতে করতে এমন একটা সময় আসবে যখন থাকবে শুধু অপরিকল্পিত উন্নয়ন, দূষণ আর রোগগ্রস্ত জীবন। তখন কোনো কিছুর বিনিময়ে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা ও সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব হবে না! সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে সব ধরনের দূষণ রোধ করেই উন্নয়নে জোর দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এ সময়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ তথা সার্বিক পরিবেশ রক্ষা করে এগিয়ে যেতে না পারলে নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশ চরমভাবাপন্ন বাংলাদেশে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না!

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close