নিতাই চন্দ্র রায়

  ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮

স্মরণ

তারামন বিবি তোমাকে সালাম

বিজয়ের মাসের প্রথম প্রহরে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চির বিদায় নিলেন এক মহীয়সী নারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা,তারামন বিবি। তারামন বিবি, প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, ইলামিত্র ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মতো মহীয়সীরা বাঙালি নারীদের অহংকার। তারামন বিবি আমাদের হৃদয়ে লাল-সবুজ পতাকার রং।

পরপর দুবার যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ায় তার ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসনালিতে প্রদাহ ও ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন তিনি। এ অবস্থায় গত ৮ নভেম্বর, অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ময়মনসিংহের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেদিনই বিকেলে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। তিনি হাসপাতালে থাকতে অনীহা প্রকাশ করায় গত ২২ নভেম্বর, বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয় তাকে। শুক্রবার রাতে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রাত দেড়টায় কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার মৃত্যুতে সারা রাজীবপুর উপজেলায় বিষাদের ছায়া নেমে আসে। এক পলক দেখার জন্য হাজার মানুষ ছুটে যান তার গ্রামের বাড়িতে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তিনি স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান।

অসীম সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়তমা মাতৃভূমিকে ভালোবেসে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেন। রুখে দাঁড়ান রাজাকার-আলবদরদের। বীর প্রতীক তারামন বিবি ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামের এক সাধারণ গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুস সোবাহান, মায়ের নাম কুলসুম বিবি। ১৯৭১ সালে তারামন বিবি ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন। তখন ১১ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। সে সময় এক সন্ধ্যায় কচুরমুখি তুলছিলেন রান্নার জন্য তারামন। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম মুহিব হালদার। মুহিব হালদার তারামনের মায়ের অনুমতি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আসেন তাকে। ক্যাম্পে তারামন মূলত রান্নাবান্নার কাজই করতেন। এ ছাড়া অস্ত্র মুছা, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ও আবার প্রয়োজনের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেওয়ার মতো কঠিন কাজগুলোও করতেন তারামন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩-১৪ বছর। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মুহিত হালদার তারামনকে অস্ত্র চালানো শিখাতেন। প্রথমে রাইফেল ও পরে স্টেনগান। তারামন গাছে চড়তে জানতেন। সাঁতার কাটতেও পারতেন। পারতেন পাগলির অভিনয় করতে। মায়ের ছেঁড়া শাড়ি পরে, গায়ে গোবর, মাটি মেখে, পাগলির বেশে চলে যেতেন পাকসেনাদের ক্যাম্পে গোপনে খবর সংগ্রহের কাজে। খবর নিতেন ক্যাম্পের কোথায় কী আছে? অস্ত্রগুলো মজুদ আছে কোথায়? বড় ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সেই কাজ। সাহসী তারামন একটুও ভয় পেতেন না। পাকিস্তানি সেনারা সন্দেহ করলে, নাম জিজ্ঞাসা করলে চুল দিয়ে মুখ ঢেকে বলতেন, সে পাগল। এসব কাজে তাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হতো। খাওয়ার সময়ও পেতেন না।

একদিন দুপুরে খাবার সময় তারামন ও তার সহযোদ্ধারা জানতে পারেন, পাকবাহিনী একটি গানবোট নিয়ে তাদের দিকে আসছে। তারামন তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন এবং তারা শত্রুদের পরাস্ত করেন। এরপর তারামন অনেক সম্মুখযুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নেন। বহুবার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করে, তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবারই বেঁচে যান। যুদ্ধ শেষে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধে তার অসীম সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত খনিতে লুকায়িত সোনার আকরিকের মতো অদৃশ্য ছিলেন তারামন বিবি। তাকে খুঁজে বের করেন ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিমল কান্তি দে। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন ভোরের কাগজের কুড়িগ্রামের সংবাদদাতা পরিমল মজুমদার, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান আলী এবং রাজীবপুর কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী।

সময়টা তখন ভীষণ খারাপ। মুক্তিযুদ্ধের কথা মুখে উচ্চারণ করাও যেন অপরাধ। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের প্রচ- প্রতাপ সারা দেশে। মুক্তিযোদ্ধাদের বড় দুর্দিন। কেউ অনাহারে, কেউ অর্ধাহারে মারা যাচ্ছেন। কেউ করছেন রাস্তায় ভিক্ষে। সে সময় রাজীবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে জানা যায়, তারামন নামের এক যক্ষ্মারোগী চিকিৎসা নিতে আসেন তার কাছে। সেই সূত্র ধরেই বিমল কান্তি দে হাজির হন তারামন বিবির বাজীবপুরের বাড়িতে। একপর্যায়ে নিশ্চিত হন এই সেই তারামন বিবি, মুক্তিযুদ্ধে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন যিনি। এ ঘটনার এক দিন পর ৬ নভেম্বর, ১৯৯৫ ভোরের কাগজের সংবাদদাতা পরিমল মজুমদার তারামনের বাড়ি যান। চেয়ে দেখেন, পড়নে ছেঁড়া শাড়ি। জীর্ণশীর্ণ শরীর। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত। খুক খুক করে কাশেন। ঢেঁকিতে অন্যের চাল ভেনে বেঁচে আছেন অতি কষ্টে। কথা প্রসঙ্গে তারামন বলেন, সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তিনি যে একজন বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাÑ এ কথা জানা ছিল না তার। পরিমল মজুমদার তার ছবি তোলেন। রিপোর্ট পাঠান পোস্ট অফিসের মাধ্যমে খামে। ১৪ দিন পর ২১ নভেম্বর ভোরের কাগজের ‘এই জনপদ’ পাতায় খবরটি ছাপা হয় গুরুত্ব সহকারে। খবরের শিরোনাম ছিল ‘বীর প্রতীক খেতাবধারী মহিলা মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির সন্ধান মিলেছে।’ খবরটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ হয় উবীনীগ ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার ফরিদা আখতারের। তারামনকে তিনি ঢাকায় নিয়ে আসেন। এ খবর বিবিসির তৎকালীন সাংবাদিক আতাউস সামাদের কানেও পৌঁছে যায়। তিনি তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে যোগাযোগ করেন। তারামন বিবিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার গলায় বীর প্রতীকের খেতাবের মেডেল পরিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় ২৫ হাজার টাকা। ওই সময় তারামন বিবি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমাকে যেমন ডেকে এনে সম্মান করলেন, দেশের সব মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেবেন। তারা যেন দুবেলা দুমুঠু ভাত খেতে পায়।’ তারামন বিবির জন্য তহবিল গঠন করে ভোরের কাগজ। জমা হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা। ওই টাকা দিয়ে রাজীবপুরে তারামন বিবির জন্য বাড়ির জায়গা ও চাষাবাদের জমি কিনে দেওয়া হয়। এরপর পদ্মা, মেঘনা, ধরলা দিয়ে কত পানি গড়িয়ে গেছে। তারামন বিবিও আর অচেনা থাকেননি। অনেক খ্যাতি, অনেক যশ ও অনেক সম্মান মিলেছে তার ভাগ্যে।

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে তিনি এলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এআইএস বিভাগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে। ২৬ মিনিট বক্তৃতা দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনালেন। আফসোস করে বললেন, ‘তারামনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু চোর-ডাকাতকে রাষ্ট্র খুঁজে পায়। তারামন দেশ স্বাধীন করেছে। চোরও না ডাকাতও না। তাকে খুঁজে পেতে কেন এত সময় লাগল? সে সময় সাংবাদিকরা খুব ভিড় করতে লাগলেন। তারা জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী চাই? আমি চাই পদক। শুধু আমার জন্য নয়। সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য।’ বক্তৃতার শেষপর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘ তোমাদের কাছে আমার দাবি রইল, তোমরা সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের চিনতে শেখো। আমি নারী হয়ে যদি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারি। তাহলে তোমরা সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের চিনতে পারবে না কেন...! আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। শিগগির আমরা সবাই হারিয়ে যাব। হঠাৎ করে শুনবে আমিও মরে গেছি। তোমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাস। দেশকে ভালোবাস। পতাকা আর মানচিত্রকে ভালোবাস। অনুুষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তিনি একটি ছোট শিশুর হাত বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে বলেন, ‘আমার ফুসফুসটা ভালো নেই। তোমাদের বুকের তাজা নিঃশ্বাসে দেশটাকে সজীব রেখো। ভালো রেখো।’ তারামন বিবির কথাই সত্য হোক। দেশটা ভালো থাকুক। সুখ-শান্তিতে থাকুক দেশের সতেরো কোটি মানুষ।

তারামন বিবির পুণ্য স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তার গ্রামের বাড়ি শংকর মাধবপুরে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তার সম্মানে তৈরি করা যেতে পারে স্মৃতিসৌধ। নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান, সাহসীকতা ও বীরত্ব গাথার গল্প অন্তর্ভুক্ত করে দেশের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাকে নিয়ে গল্প ও উপন্যাস লিখতে পারেন দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন চিত্রপরিচালকরা। সাহসীকতাপূর্ণ কাজের জন্য সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে প্রবর্তন করতে পারে ‘তারামন বিবি স্বর্ণপদক’।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close