সাধন সরকার

  ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮

মতামত

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণ সমাজ

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-কর্ণফুলী নদীবাহিত পৃথিবীর বৃহৎ বদ্বীপ তথা বাঙালি-বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় মাস ডিসেম্বর। বাংলাদেশের গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য ও আলাদা। অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি কখনো মাথানত করেনি। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রক্তে রঞ্জিত ও বিভীষিকাময়। এর সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে বীজ রোপণ করা হয়েছিল তা একের পর এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরষ্কুশ বিজয় লাভ করলেও বাঙালির হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। অতঃপর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ গর্জে ওঠে বাঙালির কণ্ঠস্বর- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কূটকৌশল, ষড়যন্ত্র ও বাঙালি নিধনযজ্ঞ থামেনি। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাঙালির ওপর সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ডের রাত ২৫ মার্চ। এ রাতের শেষভাগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আসে ঐতিহাসিক মহান বিজয়। বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় বুঝতে পেরে বিজয়ের আগ মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে মেতে ওঠে। কিন্তু কোনো বাধাই বাঙালিকে রুখতে পারেনি। চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে বিদেশি শাসনের অবসান হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয় ‘জয় বাংলা’।

বর্তমান সময়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যায় পাকিস্তানের থেকে আজকের বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। যে মাতৃভূমিকে ভালোবেসে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল সে আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যেতে পারে না। যে ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য বাঙালি জাতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে ভাষা ও সংস্কৃতি-মূল্যবোধ সমগ্র বাঙালি-বাংলাদেশিদের জন্য পথচলার অনন্ত প্রেরণা। ৪৭ বছরে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়েছে। বাংলাদেশ বিশে^ এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প কোনো কোনো সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠতে চেষ্টা করলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-শক্তির কাছে সবসময় পরাস্ত হয়েছে। এখন সময় এগিয়ে যাওয়ার। প্রত্যেকটি নাগরিককে এখন দেশপ্রেমিক হতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। জাতির পিতাও সে কথা বলে গেছেন। তিনি চেয়েছিলেন সবাই মিলে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে। যে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার স্বপ্নে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল হাজার হাজার বীর বাঙালি সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণ জনগোষ্ঠীকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে তরুণরাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজয় দেখতে তরুণদেরকেই এখন কাজ করতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইভটিজিং, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে রুখে দাঁড়াতে হবে। অপহরণ, গুম, খুন, হত্যা ও নারী নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। নারীরা যেন কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার না নয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এখনকার তরুণরা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিন্তু তারাই যুদ্ধাপরাধারীদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তরুণদের এই চেতনা ও দেশপ্রেমকে কাজে লাগাতে নীতিনির্ধারকদেরও সঠিক ভূমিকা রাখতে হবে। তরুণ সমাজকে কোনো অদৃশ্য শক্তি যাতে বিপথে পরিচালিত করতে না পারে সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের সজাগ থাকতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলতা, উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ রুখতে তরুণ সমাজকেই এখন অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় অবতীর্ণ হতে হবে। এককথায়, সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন সূচক ও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে এখন সবাইকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণরাই সবচেয়ে বড় শক্তি। তরুণদেরকে স্বপ্ন দেখাতে হবে। তরুণদেরকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সব বাধা অপসারণ করতে হবে। এখনকার তরুণরা দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসে। সে প্রমাণ তারা বিভিন্ন সময় দিয়েছে! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী তরুণ সমাজ নিজ নিজ অবস্থান থেকে যত বেশি সক্রিয় হবে স্বপ্নের ডিজিটাল সোনার বাংলা গড়তে জাতি তত আত্মবিশ্বাসী হবে। বিজয়ের এ মাসেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে এটাই প্রত্যাশা। রক্ত দিয়ে যে গৌরবোজ্জ্বল বিজয় অর্জিত হয়েছে তা কখনো বৃথা যেতে দেব না- বিজয়ের মাসে তরুণ সমাজের এই হোক অঙ্গীকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close