আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

সামাজিক অবক্ষয় বনাম অস্থিরতা

সমাজবিজ্ঞানী জনাথান হ্যাইট বলেন, ধর্ম, ঐতিহ্য ও মানব আচরণÑ এই তিনটি বিষয়ে নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এবার আমরা দেখি আমাদের প্রেক্ষাপট। ধর্মীয় বিষয়ে আমরা একেবারেই অসহিষ্ণু! অন্য ধর্মের বিষয়ে আমরা সহ্য করতে পারি না! সত্য-মিথ্যার ধারধারি না! আমাদের ঐতিহ্যের অনেক কিছু আজ অন্য জাতি কর্তৃক দখল হয়ে যাচ্ছে বা গেছে। আর মানব আচরণ ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে! এসব কিন্তু ভয়াবহতার কথা বলবে। নেগেটিভ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত।

আর নৈতিকতা হচ্ছে ধরন বা ভালো আচরণ। মানসিক অবস্থা, যা অপরের মঙ্গল কামনা করে বা করতে অনুপ্রেরণা দেয়। আর মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী ধারণা বা আদর্শ। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট সি, ডাজ বলেছেন, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে ওইসব রীতিনীতির সমষ্টি, যা ব্যক্তি সমাজের কাছ থেকে আশা করে এবং যা সমাজ ব্যক্তির কাছ থেকে লাভ করে।’ সমাজবিজ্ঞানী বেসারের মতে, ‘সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সেসব গুণাবলি, যা ব্যক্তি নিজের সহকর্মীদের মধ্যে দেখে খুশি হয় এবং নিজের সমাজ, জাতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশে মূল্যবান মনে করে খুশি হয়।’ আলোচনা করলে দেখা যাবে, এদিকে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি।

স্বাধীনতার ৪৬ বছরে আমাদের সমাজটা কতদূর এগিয়েছে। সামাজিক শৃঙ্খলা, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা আমাদের যাপিত জীবনে কতটা অর্জিত হয়েছে। সমাজে কতটা অপরাধপ্রবণতা কমেছে, শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজটা কতটা নিরাপদ, সমাজ কাঠামো কতটা উন্নত হয়েছে, সার্বিক বিবেচনায় আমাদের সমাজটা নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধের দিক থেকে কতটা এগিয়েছে, আজ এ প্রশ্নগুলোর উত্তর বিচার-বিশ্লেষণ করা খুবই জরুরি বলে মনে করি।

লোভ, ন্যায়বিচার, বৈষম্য, নৈতিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে, ফলে আত্মহত্যা ও হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলছে। পারিবারিক কলহ, যৌনাচার, অশ্লীলতা, ধর্ষণ, খুন, ইভটিজিং, অ্যাসিড-সন্ত্রাস, শিশু হত্যা-নির্যাতন, মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সামাজিক সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোয় ফাটল ধরছে, ঢুকে পড়ছে অবিশ্বাস। ফলে বাবা-মায়ের হাতে সন্তান বা বিপরীত, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে, যা সমাজ অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ।

সবচেয়ে বেশি অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে যুবসমাজ, যারা একটি দেশ বা জাতির ভবিষ্যৎ। তারা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে, হয়ে যাচ্ছে বখাটে, মদ্যপ, ধর্ষক ও সন্ত্রাসী। ইতিহাস ঐতিহ্য আর ক্রমবর্ধমান সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে মানুষ তার আপন সত্তার কথা ভুলে গিয়ে নফসের তাঁবেদারিত্তের মত্ত হওয়ার প্রবণতাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

হতাশা, নিঃসঙ্গতা, অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তি আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অনেকেই। সন্তানকে যথেষ্ট সময় না দেওয়া, অবৈধ আয়, অসম বণ্টন, সুশাসনের অভাব ইত্যাদি সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। কৃত্রিমতা, চাতুরতা, স্বার্থপরতা, তিক্ততা, হীনমন্যতা, ঈর্ষা, ক্রোধ, অহমিকা, দাম্ভিকতা, অনাচার-অবিচার, অকৃতজ্ঞতা, বেহায়াপনা, অবিচার, নৃশংসতা, বহুগামিতা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, অত্যাচার, ষড়যন্ত্র, খুন, গুম, অপহরণ, আদায়, ঠকবাজি, প্রতারণা, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, যৌতুক, মাদক, বাল্যবিয়ে, চোরাচালানি, মজুদখোরি, ফিল্ম, পর্ণো, বিজাতীয়, আকাশ সংস্কৃতির অবাধচর্চা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ফেসবুক, পরকীয়া, ঝগড়া, কলহ, বিরোধ, গোপনে অবৈধ মেলামেশা, ইভটিজিং, অ্যাসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু ধর্ষণ, শিশুখাদ্যে বিষক্রিয়া, চাঁদাবাজি ও বোমাবাজি। অনৈতিক কর্মকা- ঘটনাও ঘটছে। এগুলো সামাজিক অবক্ষয়ের চরম ও হতাশাজনক চিত্র!

দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এক শ্রেণির ভুয়া চিকিৎসক, ভুয়া শিক্ষক, ভুয়া পুলিশ, ভুয়া র‌্যাব, ভুয়া সাংবাদিক, দালাল, ভুয়া উকিল, ভুয়া পরিদর্শক, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার দৌরাত্ম্য সমাজকে কলুষিত করে সামাজিক অবক্ষয় ডেকে আনছে। পরিবারের বয়স্ক বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণে সন্তানদের বিমাতাসুলভ আচরণ মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ। সমাজে পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি বৃত্তবানদের প্রয়োজনীয় নৈতিক দায়িত্ববোধ দিন দিন কমে যাচ্ছে।

ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি/বৃদ্ধি এ অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে! এ ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের অধিক প্রচার করতে হবে। শিক্ষকরা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। তারা ক্লাস বা বাইরে মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। আবার সাংবাদিক/লেখকরা পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম। এ ব্যাপারে তারাও অগ্রণি ভূমিকা পালন করতে পারেন। অপরাধের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে আমাদের বা প্রশাসনকে। অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বা দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে এসব বিচার করা যেতে পারে। বিচারবিভাগীয় তদন্ত/নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। অবশ্য অপরাধী ধরতে আমাদের শতভাগ সাহায্য ও সহযোগিতা করতে হবে। তদুপরি কঠোর ও শক্তিশালী আইন প্রণয়ন ও তার কঠোর প্রয়োগ অবক্ষয় বা বিকৃত এ রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে! যেন আইনের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে অপরাধীরা পার না পায়, সে বিষয়ে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে!

সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। শিক্ষা বা ধর্মীয় অপব্যাখ্যা বন্ধ করতে হবে। এ জন্য ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তদারকি করতে হবে কঠোরভাবে। জনসাধারণকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে। তাই বলা যায়, সরকার, জনসাধারণ, বুদ্ধিজীবীরা সবাইকে একই প্ল্যাটফরমে আসতে হবে। তাহলেই শিশু নির্যাতন ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে বাঁচা যাবে!

লেখক : উপপরিচালক (বিআরডিবি), লালমনিরহাট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close