অলোক আচার্য

  ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮

মতামত

স্বপ্ন এবং স্বপ্নপূরণ

একাদশ জাতীয় সংসদের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ শুরু করেছে। ঐক্যফ্রন্ট তাদের ইশতেহার ঘোষণা করেছে এবং আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই প্রত্যেক দলই যার যার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করবে। নির্বাচনে ইশতেহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে ইশতেহার শব্দের আরেক অর্থ কিন্তু বিজ্ঞাপন। অনেক বিজ্ঞাপনে যেমন বাস্তবের সঙ্গে মিল থাকে না, তেমনি ইশতেহার যেন জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য কোনো প্রচার না হয় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সাধারণ জনগণের চাওয়া। ইশতেহার প্রকাশের আগেই রাজনৈতিক দলগুলো তরুণ ভোটারদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। তাদের ঘোষণা করা ইশতেহারেও যে সে রকম ইচ্ছার প্রতিফলন এবং তা বাস্তবায়নের আন্তরিক থাকবে, সেটাই আশা করছি। এ মুহূর্তে দেশে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো সমাধানের প্রতি জোর দিতে হবে। যেহেতু অনেক যাচাই-বাছাই করে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তাই ধরেই নেওয়া যায় এই প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকার জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয়। তারা এলাকার উন্নয়ন করতে সক্ষম। আসন্ন নির্বাচন জোট মহাজোটের। ছোট দলগুলো বড় দলের সঙ্গে একত্র হয়ে জোট গঠন করছে। কিন্তু ভোটের মাধ্যমে জনগণ তাদের উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচিত করবে। জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন ঘটাতে পারবে যারা, নিঃসন্দেহে ভোট তার পক্ষেই যাবে। ভোটের মূল হলো জনগণ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হলো উপযুক্ত ব্যক্তি মনোনয়ন করা। কারণ আগামী পাঁচ বছর তাদের জীবনযাত্রাসহ অনেক কিছুই এসব নির্বাচিত নেতার ওপরই নির্ভর করবে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার সবার সামনে তুলে ধরে। এই ইশতেহার হলো ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা। কারণ মার্কিন বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বোঝাতে পেরেছিলেন। অভিবাসীদের জায়গায় নিজেদের দেশের যুবকদের কাজের সংস্থান করতে চেয়েছিলেন তিনি। আমাদের দেশের নির্বাচনের তরুণ ভোটার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। এটিই বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। কারণ এ নির্বাচনে প্রায় তিন কোটি তরুণ ভোটার রয়েছে। তারা শিক্ষিত এবং সচেতন। তরুণ ভোটারদের একটি বড় অংশই দেশের অর্থনীতি এবং অগ্রগতি নিয়ে সচেতন। তারা কোন দিকে যাবে তা তাদের সিদ্ধান্ত।

তরুণ ভোটারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো তাদের ভবিষ্যৎ। তাদের ভবিষ্যৎ যে রাজনৈতিক দলের কাছে উজ্জ্বল এবং ভালো মনে করবে, ভোট তাদের দিকেই যাবে। তবে এই বিপুল ভোটার যেদিকে তাদের রায় জানাবে, তারা সুবিধাজনক স্থানে থাকবে, এটা অনুমেয়ই। তাই নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চাহিদার ওপর গুরুত্বারোপ করার চেষ্টা করবে। সব রাজনৈতিক দলই চেষ্টা করছে তরুণ ভোটারদের তাদের পক্ষে টানতে। কিন্তু তাদের চাহিদা কী বা তরুণদের জন্য কী কী প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করছে, সেসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাবতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের জন্য পরিকল্পনা রাখতে হবে। তরুণরা চায় তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে। যে দল সেই স্বপ্নপূরণে সাহায্য করবে, তরুণদের ভোটব্যাংক তাদের দিকেই যাবে এটা নিশ্চিত। আওয়ামী লীগ সরকার তরুণদের টানতে তাদের সময়কালীন বিভিন্ন উন্নয়নচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো, দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও দেশকে নিয়ে তার অসমাপ্ত স্বপ্ন এবং পাশাপাশি দেশবিরোধীদের কথা বিভিন্ন সময় তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশন ছিল গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি অন্যতম বিষয়। সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে ব্যাপক হারে ডিজিটাল পদ্ধতির সংস্কার করা হয়েছে। অনেক সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ইন্টারনেটভিত্তিক কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে আজ বহু তরুণ-তরুণী ঘরে বসে আয় করছে। সরকারিভাবে এদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশের বেকারত্ব, দুর্নীতি এখনো বড় ধরনের সমস্যা হয়ে রয়েছে।

তাই প্রায় আড়াই কোটি তরুণ ভোটার একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৮ বছর থেকে ২৮ বছর পর্যন্ত এসব তরুণ ভোটার উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে চাকরি খোঁজা এর স্তরে থাকে। এ স্তরে এসে প্রথম স্বপ্ন দেখে একটি চাকরি পাওয়া। কারণ নি¤œ বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে পড়ালেখা শেষ করা তরুণদের কাছে এমন কোনো সুযোগ থাকে না বা পরিবার থেকে ব্যবসা করার মতো পুঁজির যোগ্যতা থাকে না। তাই চাকরিই প্রথম পছন্দ থাকে। সে ক্ষেত্রে চাকরির বাজারে সমান সুযোগ থাকাটা এরা প্রত্যাশা করে। সম্প্রতি কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সরকার দাবি মেনে নিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি থেকে কোটা তুলে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবার জন্য মেধার সমান সুযোগ থাকছে। এটা মেধাবী তরুণদের জন্য স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এর পাশাপাশি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা অপরিহার্য। স্বচ্ছতা বলতে বোঝায় ঘুষ বা উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে চাকরির প্রত্যাশা। কিন্তু আমাদের দেশে বহু দিন ধরেই চাকরিতে নিয়োগে টাকা এবং ক্ষমতার প্রভাব লক্ষণীয়। যার বাবার টাকা আর মামার জোর আছে, সে-ই কুলীন হয়। তাই একসময় চাকরিপ্রার্থী হতাশ হয়ে পড়ে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন এবং সে পথে অগ্রগতি বর্তমান সরকার অনেকটাই অর্জন করেছে। তবে দুর্নীতিটা রয়ে গেছে। আর ঠিক এ কারণেই ইশতেহার গুরুত্বপূর্ণ। ইশতেহারে তরুণ চিন্তা-ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। চাকরির নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে তাই ঘুষবাণিজ্যমুক্ত চাকরির বিষয়টি প্রতিফলিত হতে হবে। তা ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য ইন্টারনেটের মূল্য এখনো অন্য দেশের তুলনায় বেশি। তাই ইন্টারনেটের দাম কমাতে হবে। যেসব কাজ ইন্টারনেটভিত্তিক, সেগুলো করতে যাতে ন্যূনতম খরচ হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

অনেক দাবি পূরণ হলেও চাকরিতে প্রবেশের দাবি রয়েছে তরুণদের। তারা দীর্ঘদিন ধরেই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাদের আশা ছিল নির্বাচনের আগেই কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কিন্তু তরুণদের অনেক দাবি পূরণ হলেও এই দাবি পূরণ হয়নি। কিন্তু চাকরিতে অবসরের বয়স বৃদ্ধি পেলেও প্রবেশের বয়স সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। তা ছাড়া অন্য অনেক দেশেই চাকরিতে প্রবেশের বয়স বেশি। তা ছাড়া দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু পড়ালেখা শেষ করতেই একটি বড় সময় পার হয়ে যায়। ফলে চাকরি খোঁজা এবং প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় পায় না। দেশের চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিবিএসের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ। এর মধ্যে আবার শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, যা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। যে কারণে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হবে। বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের চাওয়া। এ কথা বলা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে তরুণদের চাওয়ার প্রতিফলন রাখবে এবং ইশতেহার কেবল নির্বাচনী উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহৃত হবে না বরং তা বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close