মোতাহার হোসেন

  ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে করণীয়

দেশের মানুষ এখন নির্বাচনী জ্বরে আক্রান্ত। কম বেশি সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নির্বাচনের দিকে। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিনি নিয়েও তাদের ভাবনা রয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। একই সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখার বিষয়টি, যদিও নির্বাচনী ঢামাঢোলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখাটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। তবে নির্বাচন কমিশন এ নিয়ে ইতোমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। পাশাপাশি এ জন্য গত কয়েক দিনে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন পুলিশের আইজির নেতৃত্বে। এসব বৈঠকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সমূহের প্রতিনিধিরা ছিলেন। আবার র‌্যাব নিজেরাও কয়েক দফা বৈঠক করেছেন নিজেদের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে। কিন্তু নির্বাচনী মহড়ার শুরুর দিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি-যুবদল-ছাত্রদল যে দৃশ্য দেখাল তাতে নির্বাচনকালে সহিংতার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। বিশেষ করে বিনা উসকানিতে সেদিন পুলিশের ওপর মারমুখো আচরণ, পুলিশের দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ প্রভৃতিতে শঙ্কাটা বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া জঙ্গি হামলার আশঙ্কাও করছেন অনেকে। নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, দাগি সন্ত্রাসী ও মাস্তানদের তালিকা ধরে গ্রেফতার করা জরুরি।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী নির্বাচনকালে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জিরো টলারেন্স নীতিতে মাঠে নামছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা। নির্বাচনে পরিস্থিতি ঘোলা করে ফায়দা লুটতে একটি গোষ্ঠী চক্রান্ত করছে এবং ইতোমধ্যে নাশকতা সৃষ্টির জন্য শোডাউন করেছে একটি দল। একাধিক গোয়োন্দা সংস্থা সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে প্রদত্ত রিপোর্টে নির্বাচন বানচালে নাশকতা সৃষ্টির আশঙ্কা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার আগাম গোপন তথ্য পেয়েছে সরকারি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। পাশাপাশি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ থানা, চেকপোস্ট, পুলিশের স্থাপনাগুলোতে নাশকতা সৃষ্টির আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থা সমূহ। এমনি অবস্থায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাবও দিয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আইন প্রয়োগকারী অপরাপর সংস্থকে এ ব্যাপারে রিপোর্ট দিয়েছে তারা। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। তিনি বলেন, জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদক শূন্য পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত অভিযান চলবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানান, নির্বাচনকে সামনে জঙ্গি, স্বাধীনতাবিরোধী, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি স্পর্শকাতর স্থাপনা, পুলিশ ষ্টেশন প্রভৃতিতে নাশকতা চালাতে পারে এমন তথ্য আছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থাকে এলার্ড করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আনসার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘কুইক রেসপন্স টিম’কে। সরকার কোনোভাবেই আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে দেবে না। প্রয়োজনে অপরাধীদের তালিকা ধরে দেশব্যাপী ধারাবাহিক অভিযান পরিচালিত হবে। এমন তথ্য জানিয়ে সূত্র জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ১৯ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনাটি সম্প্রতি অ্যাডিশনাল আইজি, র‌্যাব মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, পুলিশ কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতনদের পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনার চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, পুলিশের স্থাপনার ওপর নাশকতা হামলার আশঙ্কা রয়েছে। সম্ভাব্য নাশকতা রোধকল্পে পুলিশ সদরদপ্তরসহ বাংলাদেশ পুলিশের সকল স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সদর দফতর, ডিএমপি, এসবি, সিআইডি, র‌্যাব সদর দপ্তর সব পুলিশ স্থাপনায় স্ক্যানিং করে গাড়ি প্রবেশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া প্রবেশের পূর্বে সেই গাড়ি ও ব্যক্তিগত সামগ্রী তল্লাশি করতে হবে। আগতদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে হবে। থানাসহ স্থাপনাসমূহে সাহায্যকারী, দর্শনার্থীদের নাম-ঠিকানা ও তাদের আগমনের উদ্দেশ্য রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদর দফতর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, অস্ত্রাগারে ও পুলিশ লাইনের প্রবেশপথে নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র পুলিশ ও তল্লাশির জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করতে হবে। ক্যাম্প ও ফোর্সের নিরাপত্তা বিবেচনায় নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। থানা কিংবা স্থাপনার মেইন গেট ঝুঁকিপূর্ণ থাকলে সেগুলোকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবগত করে নির্মাণ অথবা মেরামত করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ পুলিশ স্থাপনাসমূহের সীমানা প্রাচীর উঁচু করতে হবে অথবা কাঁটাতারের বেড়া দিতে হবে। রাতে থানা ও পুলিশ ফাঁড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।

থানাসহ পুলিশ ইউনিটসমূহে মেইন গেট বন্ধ রেখে পকেট গেট খোলা রাখতে হবে। কেউ হেঁটে বা গাড়িতে প্রবেশ করতে চাইলে তার নাম-পরিচয় নিয়ে তল্লাশি করে প্রবেশ করাতে হবে। নম্বরবিহীন গাড়ি ও মোটরসাইকেল পুলিশ স্থাপনাসমূহে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। বরাদ্দ অনুযায়ী ইউনিট প্রধানদের ভেহিকেল সার্চিং মিরর, হ্যান্ড হেল্ড মেটাল ডিটেক্টর, টর্চ, হ্যালোজেন লাইট ও সিকিউরিটি লাইট নিশ্চিত করতে হবে। সকল ইউনিট প্রধানকে নিরাপত্তার বিষয়ে নিয়মিত ব্রিফিং ও দায়িত্ব পালনে পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অফিস প্রধানগণ সময়ে-অসময়ে আকস্মিকভাবে তার অধীন ইউনিটসমূহ পরিদর্শন করবেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন। ব্যক্তিগত দেহরক্ষী, অধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ পেশাগত জ্ঞান, অস্ত্র চালানোর সক্ষমতা এবং নিরাপত্তা সচেনতা সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চিত হবেন।

সকল অফিসার ও ফোর্সকে মাঝে মাঝে অস্ত্র খোলা, জোড়া লাগানো, অস্ত্রের নিরাপত্তা, অস্ত্র চালানোর কৌশল রপ্ত করতে হবে। ইউনিট প্রধানগণ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করবেন। বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটে অস্ত্রগারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইউনিট প্রধানগণ পিআরবিতে বর্ণিত বিধিবিধানের কোনো ব্যত্যয় ব্যতীত পরিপূর্ণভাবে পালন করবেন।

পুলিশ সুপার ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা বিভিন্ন পুলিশ ইউনিট নির্ধারিত/আকস্মিক পরিদর্শনে গেলে পুলিশ ইউনিটসমূহের নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই অবহিত করবেন এবং পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করবেন। এসিআর মূল্যায়নকারী/প্রতি স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তারা মূল্যায়নধীন পুলিশ কর্মকর্তার নিরাপত্তা সচেতনতার বিষয়টি বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করবেন। পুলিশ ইউনিটসমূহের নির্দেশাবলি প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যগণ পেশাগত কারণে কঠোর ও বিনয়ী হবেন এবং কোনোক্রমেই যাতে অহেতুক হয়রানি না হয়, ইউনিট প্রধানগণ সে বিষয়ে নিশ্চিত করবেন। এ-সংক্রান্ত ‘বাংলাদেশ পুলিশ সদস্য ও স্থাপনা সংক্রান্ত নিরাপত্তা নির্দেশিকা’ অনুসরণ করতে হবে।

নিরাপত্তা নির্দেশিকায় সন্ত্রাসী হামলার সময় দ্রুত ‘কুইক রেসপন্স টিম’ পাঠানো, ২৪ ঘণ্টার স্ট্রাইকিং টিম প্রস্তুত রাখা, ব্যকআপ সাপোর্ট (এপিবিএন, র‌্যাব, বিজিবি) ইত্যাদি প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও পুলিশ সদর দপ্তরসহ দেশের সকল জেলা, থানা, মেট্রোপলিটন এলাকায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে প্রেরিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বাসা ও মেস ভাড়া দেওয়ার আগে আগতদের যথাযথভাবে পরিচয় নিশ্চিত, বাস-রেলস্টেসন, স্থল, বিমান, নৌবন্দরে নিয়ন্ত্রণ ও আকস্মিক তল্লাশির ব্যবস্থা, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বিকাশের মতো মোবাইল মানি অ্যাকাউন্ট পরিচালনাকারী এজেন্টদের পরিচয় ও কার্যকর যাচাই-বাছাই এবং নজরদারির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যে কোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ জন্য যা যা করার তা করবেন নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close