মো. মাঈন উদ্দিন

  ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

রফতানি বাণিজ্যে সুবাতাস

আমরা এমন এক বাংলাদেশে বাস করি, সেখানে দুই দশক আগেও বেকার লোকরা দিনমজুরি কাজ পেত না। তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করত। খাবারের জন্য কোলের শিশুরা কান্নাকাটি করত। কিন্তু বেকার বাব-মায়ের কিছুই করা ছিল না, শুধু বুকফাটা আহাজারি ছিল তাদের হৃদয়জুড়ে। কিন্তু তলাবিহীন ঝুড়ি নামেখ্যাত সেই বাংলাদেশ আজ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সেই বাংলাদেশ আজ অপার সম্ভাবনার প্রান্তরের বুকভরা নিঃশ্বাস নেওয়ার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। আজকাল শহর কেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মানুষও না খেয়ে মারা যায় না। এমনও দেখা গেছে, একজন ভীক্ষুকেরও আজকাল ব্যাংক-ব্যালেন্স আছে। এই যে সম্ভাবনার দুয়ার খোলছে। তার পেছনে রয়েছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা, সেই সঙ্গে এ দেশের মানুষের হারভাঙা পরিশ্রম। আর এই পরিশ্রমের যে ক্ষেত্রটি, তা হলো এ দেশের গার্মেন্টশিল্পসহ বিভিন্ন রফতানি অঞ্চল। এমনই একটি সম্ভাবনার খবর পেলাম গত কিছুদিন আগে একটি পত্রিকা মারফত। এতে বিজিএমইএর একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।

বিজিএমইএর তথ্য মতে, টানা তৃতীয় মাসের মতো রফতানি আয়ে ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। সদ্য শেষ হওয়া নভেম্বর মাসে পণ্য রফতানি থেকে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি অর্থ দেশে এসেছে। রফতানি আয়ের এই পরিমাণ রক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। আগের মাস অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩০ শতাংশের বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৩৩ শতাংশ। আর পাঁচ মাসের হিসাবে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে আয় বেড়েছে সাড়ে ১৭ শতাংশের মতো। মূলত তৈরি পোশাক রফতানির ওপর ভর করেই আমাদের এ অগ্রযাত্রা। বিজিএমইএর একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে। আমরা এখন বেশি দামের পোশাকও রফতানি করছি। নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করছি আমরা। জাতীয় নির্বাচনের আগেও দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। সার্বিকভাবে সবকিছুই আমাদের অনুকূলে। সে কারণেই বাড়ছে রফতানি আয়। অর্থবছরের বাকি মাসগুলোয় এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

গতকাল ৫ ডিসেম্বর বুধবার রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রফতানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রফতানি থেকে ১ হাজার ৭০৭ কোটি ৩৭ লাখ (১৭.০৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। এই পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে রফতানি আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৫২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত বছরের এই পাঁচ মাসে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৪৫৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার। নভেম্বরে ৩৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার রফতানি আয় দেশে এসেছে। এ মাসে লক্ষ্য ধরা ছিল ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। গত বছরের নভেম্বরে আয় হয়েছিল ৩০৫ কোটি ৭১ লাখ ডলার। এ হিসাবে নভেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। আর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট (মাসভিত্তিক) আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ইপিবির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট রফতানি আয়ের ৮৩ দশমিক ১০ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ ১৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৪ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারই এসেছে এ খাত থেকে। এর মধ্যে নিট পোশাক রফতানি থেকে এসেছে ৭৩০ কোটি ৬০ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ।

উভেন পোশাক রফতানি করে আয় হয়েছে ৬৮৮ কোটি ডলার; প্রবৃদ্ধি ২০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। নিটে লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়ে গেছে ১১ দশমিক ১ শতাংশ। আর উভেনে প্রায় ১২ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০ শতাংশের মতো। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টেই তা হোঁচট খায়। ওই মাসে গত বছরের আগস্টের চেয়ে আয় কমে ১২ শতাংশ। এর পরের মাস থেকে তৈরি পোশাকসহ সামগ্রিক রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। দেশের রফতানি আয়ের ওপর বরাবরই তৈরি পোশাক পণ্যের বড় ধরনের প্রভাব থাকে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প মালিকরা গত কয়েক বছরে তাদের কারখানার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধি রফতানি আয় বাড়াতে অবদান রেখেছে বলে মনে করেন পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর কর্তাব্যক্তিরা। তিনি বলেন, অর্থবছরের শুরুটা খুব ভালো হয়েছিল। কোরবানির ঈদের কারণে কয়েক দিন কারখানা এবং রফতানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায়, আগস্ট মাসে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল। সে ধাক্কা আমরা সামলে নিয়েছি। এখন প্রতি মাসেই রফতানি আয় বাড়ছে। অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতে আয় বাড়বে আশা করে তিনি বলেন, কারখানাগুলোর উন্নয়নে পোশাকশিল্প মালিকরা গত কয়েক বছরে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কষ্টও করেছেন। ৮০ শতাংশের বেশি কারখানা উন্নত কর্মপরিবেশের আওতায় চলে এসেছে। এতে বায়াররাও খুশি। এ কারণেই বিদেশি ক্রেতাদের আস্থার সঙ্গে ক্রয়াদেশও বেড়েছে বলে মনে করেন বিজিএমইএ সহসভাপতি। খুশির খবর হচ্ছে, আমরা এখন অনেক বেশি দামের পোশাকও রফতানি করছি। আমরা ক্রেতাদের পছন্দ এবং ডিজাইনের পণ্য দিতে পারছি। আমাদের প্রতি তাদের আস্থা বাড়ছে। তবে ভারত, চীন, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ মার্কিন ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার ব্যাপক দরপতন করায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে, তাতে আমেরিকার বাজারে চীনের পোশাক রফতানি কমে যাবে। সেই বাজার বাংলাদেশের দখল করার সম্ভাবনা আছে। সেটা হলে আমাদের রফতানি আরো বাড়বে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে জুলাই-নভেম্বর সময়ে কৃষিপণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৪৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে রফতানি আয় ১৬ দশমিক ১১ শতাংশ কমেছে। এ খাতে আয় দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। একইভাবে পাট ও পাটপণ্য রফতানি আয়ও কমেছে। এ খাতে আয় হয়েছে ৩৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৬৬৬ কোটি ৮২ লাখ (৩৬.৬৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। এর মধ্যে ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক রফতানি থেকে। অর্থাৎ মোট রফতানির ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশই এসেছিল এই খাত থেকেই। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সার্বিক রফতানি ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ বাড়লেও তা ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ২২ শতাংশ কম। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য রফতানি করে ৩৯ বিলিয়ন (তিন হাজার ৯০০ কোটি) ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি। এবার দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত থেকে ৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার আসবে বলে ধরা হয়েছে, যা মোট রফতানি লক্ষ্যমাত্রার ৮৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।

এই যে পরিসংখ্যানটি। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য আশাব্যঞ্জক। অমাবস্যার গভীর রাতে বিদ্যুতের চকচকে আলোয় দাঁড়িয়ে দেখা হাজার পাওয়ারি ঝকঝকে এক বাল্বকে। শুরু পরিসংখ্যানই নয়, বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনই বলে দেয় এ বাংলাদেশ আজ ঝুড়িবিহীন নয়, কনক্রিটসম তলাওয়ালা ঝুড়ির ওপর দাঁড়িয়ে। এখন দরকার অনাকাক্সিক্ষত কালপ্রিট শকুনের রক্ত-চক্ষু থেকে এ দেশকে নিরাপদ রাখা। নিরাপদ থাকা হিংস্র মানুষের অনাহুত উসকানি থেকে। তাহলেই আজকের অদম্য টাইগারের এই বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে তেজদীপ্ত অশে^র মতো।

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রেজিস্ট্রার দফতর

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close