এস এম মুকুল

  ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮

উন্নয়ন

আমার গ্রাম আমার শহর

শোনা যাচ্ছে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ স্লোগানে তৈরি হচ্ছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার। স্লোগানটি সময়োপযোগী, খুবই ভালো, গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যৎধর্মী। কেননা, আমাদের সিংহভাগ জনগণের বসবাস গ্রামীণ। বাংলাদেশের উৎপাদন, সামাজিকতা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টিসভ্যতার ধারক ও বাহক হচ্ছে বাংলার গ্রাম। আমরা যাকে গর্ব করে বলি গ্রাম-বাংলা। এক কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশে সমৃদ্ধি চালিকা শক্তির ভিত্তি হচ্ছে গ্রামীণ পটভূমি। গ্রামই আমাদের চেতনার উদ্ভাস। গ্রামই আমাদের অস্তিত্ব ও প্রেরণার শক্তি। আমাদের এ নগর সভ্যতার সিংহভাগের অবদান গ্রাম-বাংলার। আমাদের ভোগ ও বিলাসী জীবনের জোগান দাতাও গ্রাম-বাংলা। তার পরও দুঃখজনকভাবে আমরা অনেক সময় ভুলে যাই যে গ্রাম-বাংলা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত বা প্রসিদ্ধ নয়। বরং গ্রাম-বাংলা প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের অবারিত ক্ষেত্র। তাই গ্রামের প্রতি ভালোবাসা, গ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ এই বাংলাদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় সমৃদ্ধ করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

গ্রাম এলাকায় অন্তত উপজেলাপর্যায়ে শিল্প, কারখানা, গার্মেন্ট, কুটিরশিল্প স্থাপনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে জায়গা, ব্যাংক লোন, পরামর্শ ও প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ বিনিয়োগ বাড়লেই ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এলাকায় কাজ পেলে মানুষ আর শহরমুখী হবে না। শহরে মানুষের অযাচিত চাপ কমবে। দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে গ্রামীণ অর্থনীতির অবদান অনস্বীকার্য। গ্রামাঞ্চলে কৃষি, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের বেগবান ধারা আশাব্যঞ্জক। কৃষি ক্ষেত্রে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে গ্রামীণ সড়ক-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, গ্রোথসেন্টার-হাটবাজার উন্নয়ন, সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ ও পুনর্বাসন, বৃক্ষরোপণ, সøুুইস গেট, রাবার ড্যাম ইত্যাদি নির্মাণ, উপজেলা কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ, খাল খনন ও সংস্কার প্রভৃতি কর্মসূচির কারণে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রভাব পড়ছে। এখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখলেও সবাক হৃদয় অবাক হবে চারপাশের পরিবর্তন দেখে। রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রযুক্তি প্রভাবে গ্রাম-শহরের সেই দূরত্ব এখন আর নেই। গ্রামে অভাব ও অভাবী মানুষের সংখ্যা কমে এসেছে। বিদ্যুতের আলোর ঝলক কিংবা সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত গ্রাম-বাংলার ঘরবাড়ি, রাস্তার দোকানপাট। ঘরে ঘরে টেলিভিশন, ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিল, সোফাসেটসহ শহুরে আধুনিক শৌখিনতার সবকিছুই এখন কমবেশি গ্রামেও আছে। মোটকথা, এখন আর কেউ বলতে পারবে না যে দেশ অনেক পিছিয়ে আছে।

আমাদের খাদ্য, পুষ্টির জোগান আসে গ্রাম থেকে। নির্মল, চিরসবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশের রক্ষাকবচ এ গ্রাম। চিরায়ত বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহমান রাখছে এ গ্রাম। আমাদের শহুরে জীবনে বর্ণাঢ্য কলেবরে উদ্্যাপিত উৎসবগুলোÑ বাংলা নববর্ষ (পহেলা বৈশাখ), চৈত্রসংক্রান্তি, নবান্ন উৎসব, মেলা, খেলাÑএর সবকিছুর আঁতুরঘর এই গ্রাম-বাংলায়। বলা যায়, শহুরে জীবনে এসব উৎসব করে আমরা আমাদের গ্রামীণ শেকড়ের প্রতিই দুর্বলতা প্রকাশ করি। কিন্তু এই গ্রামগুলোকে যদি আরো পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসা যায়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে টেকসই এবং বহুমুখী উৎপাদনশীলতার উৎস। যেমনÑ প্রতিটি গ্রামে যদি ‘একটি বাড়ি একটি খামার’-এর আওতায় দুটি করে খামার গড়ে তোলা যায়, তাহলে প্রায় ৮৮ হাজার গ্রামে ১ লাখ ৫৬ হাজার মডেল খামার তৈরি হবে। একেকটি খামারবাড়িতে গড়ে চারজনের স্থায়ী ও খ-কালীন কাজের সংস্থান হলে কমবেশি ছয় লাখের অধিক মানুষের কাজের ব্যবস্থা হয়। এই মডেলগুলো আরো উৎসাহিত করবে অন্যদের। তাহলে একটি সরকারের মেয়াদকালে ৫ বছরে এই ৮৮ হাজার গ্রামে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মানুষের কাজের ব্যবস্থা হয়। পাশাপাশি যুব উন্নয়ন অধিদফতর, কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও ঋণ-সহায়তা দিয়ে কৃষিভিত্তিক খামার/প্রকল্প এবং ছোট ছোট উৎপাদনশীল কারখানা গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখলে গ্রামীণ পর্যায়ে ৫ বছরে ১০ লাখ মানুষের জীবিকার উৎস গড়ে তোলা যায়। গ্রামীণ পর্যায়ে প্রযুক্তিভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ৫ বছরে ৫ লাখ স্বল্পশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রতিটি গ্রাম থেকে বছরে দুজন করে সদস্যকে ঋণ সহায়তা বিদেশে পাঠালে ৫ বছরে সাড়ে সাত লাখ পরিবারের আর্থিক স্বনির্ভরতা আনা সম্ভব। কৃষি, কুটিরশিল্প ও হস্তশিল্পের বিকাশে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী কিন্তু বিলুপ্তপ্রায় ও রুগ্্ণ শিল্পগুলোকে প্রণোদনার মাধ্যমে অথবা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহ সৃষ্টির মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারলে পণ্য উৎপাদন ও রফতানির ক্ষেত্রে রেনেসাঁর সৃষ্টি হতে পারে। পুরনো এই শিল্পগুলোর পুনর্জাগরণ ঘটানো সম্ভব হলে লাখো মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোক্তাদের গ্রামীণ এলাকায় যে এলাকা যে ফসলের জন্য প্রসিদ্ধ, সে এলাকায় সেই ফসলভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলায় প্রণোদনা দিলে বিপুল মানুষের স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সরকার যদি গ্রামীণ নিরাপত্তার লক্ষ্যে গ্রামপুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে প্রতিটি গ্রামে একজন করে গ্রামপুলিশ নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। প্রতিটি ইউনিয়নে গ্রামপুলিশের স্টেশন স্থাপন করা হলে প্রতিটি স্টেশনকে কেন্দ্র করে আরো কয়েকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়। দেশের বিপুল জনসংখ্যার সার্বিক নিরাপত্তা ও জঙ্গিবাদ, মাদকসহ সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়কে জনসংখ্যার আলোকে বিবেচনা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর সদস্য দ্বিগুণ করার পাশাপাশি সেক্টর বা বিভাগ বাড়ানো দরকার, যেমনÑট্যুরিস্ট পুলিশ, র‌্যাব, কাউন্টার টেররিজম পুলিশ, ক্যাম্পাস পুলিশ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভেজালবিরোধী কার্যক্রমে একটি বিভাগসহ আরো প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এই বাহিনীর সদস্য বাড়ানোর সমূহ সুযোগ রয়েছে। যেখানে লাখো কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারে। এ ছাড়া সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য সংখ্যা জেলা কোটাকে বর্ধিত করে উপজেলা কোটায় সম্প্রসারণ করা হলে এসব বাহিনীর সদস্য পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ হবে। তাহলে এই বাহিনীগুলো শক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি এর সদস্যরা আসবে মূলত গ্রাম থেকে। আগামী যে সরকার আসবে, তারা যদি সমবায়ভিত্তিক গুচ্ছ গ্রাম বা মডেল গ্রাম তৈরির উদ্যোগ নেয়Ñ যেখানে নিজেদের অর্থায়নে কম জমির ব্যবহার করে বা ফসলি জমি নষ্ট না করে আদর্শ গ্রাম স্থাপনের মাধ্যমে উৎপাদনশীল জমি অকাজে নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। পাশাপাশি গ্রামীণপর্যায়ে সমবায়কে কাজে লাগালে আর্থিক সমৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তার সমন্বয়ে টেকসই সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। আগামীর সরকার যদি অস্থায়ী কর্মসংস্থানের জন্য ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে নদী ও খাল খনন, সরকারের পরিত্যক্ত বা খাসজমির ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়, তাহলেও বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।

এক খবরে জানা যায়, দেড় কোটি বসতভিটায় বছরে প্রায় ৫৫ লাখ টন সবজি উৎপাদন সম্ভব। আমরা জানি, সবজি চাষ এখন লাভজনক ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। স্বনির্ভরতা করছে এসব তরুণ। তাদের প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ। বর্তমানে দেশে বার্ষিক মোট সবজি উৎপাদন হয় ২৫ লাখ টন, যেখানে ১৯৭০ সালে উৎপাদন হতো মাত্র ৭ লাখ টন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমানে স্বাভাবিক পর্যায়ে যে পরিমাণ সবজি উৎপাদিত হচ্ছে, শুধু মানসম্মত ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০ ভাগ সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার আছে। এই কৃষক পরিবারগুলোর প্রায় সবাই কমবেশি সবজি চাষ করেন। এ জন্য গ্রামে গ্রামে কৃষক সমবায়ের মাধ্যমে গ্রুপ বা দল তৈরি করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। উন্নতজাতের বীজ উৎপাদনে দেশের হাজার হাজার নার্সারিকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রতিটি পরিবার যদি প্রতিদিন এক কেজি করে সবজি উৎপাদন করে, তাহলে দেড় কোটি বসতভিটা থেকে বছরে প্রায় ৫৫ লাখ টন সবজি উৎপাদন সম্ভব। এই উৎপাদন শুধু সবজির ক্ষেত্রে নয়, হাঁস, মুরগি, গবাদি পশু, টার্কি পালন, ব্ল্যাকবেঙ্গল পালন, রাজহাঁস পালন, মৎস্য চাষ, দুগ্ধ খামারসহ বহুবিধ কৃষিজ উৎপাদনে অভাবনীয় কাজে লাগানো সম্ভব। কিন্তু এসবের আগে এই ৮৮ হাজার গ্রামের দেড় কোটির অধিক কৃষক পরিবারের আর্থ-সামাজিক মর্যাদায় উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। কারণ শহরের শিল্প ক্ষেত্রেও কিন্তু শ্রমিক বা কর্মকর্তা আসছে কিন্তু আমাদের গ্রাম থেকে। এ কারণে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কেন্দ্র বানাতে হবে গ্রামকে। ভালো খবর হলো ওপরের উল্লিখিত বিষয়গুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের বিবিধ পরিকল্পনা রয়েছে। বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান। যার সুফল গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে অনেকাংশে সচল করেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গ্রামের চেহারায় শহরের আভা লক্ষণীয় বিষয়। আরো আশার খবর হলো, যোগাযোগ ও প্রযুক্তির উন্নয়নে গ্রাম ও শহরের পার্থক্য ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। শহরের ধনবান মানুষরা ইতোমধ্যে গ্রামে বিনিয়োগ করে বিভিন্ন প্রকল্প গড়ে তুলছেন। এই আশার সুতোয় এখন সম্ভাবনার মালা গাঁথতে হবে এই গ্রাম-বাংলার মানুষগুলোকে নিয়েই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close