সাধন সরকার

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

পরিবেশ

অপার সম্ভাবনার নাম

বাংলাদেশ নদীর দেশ। নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এ দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, কৃষি, অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা ও সচেতনতা। নদ-নদীর সৌন্দর্য চিরকাল মানুষকে মুগ্ধ করেছে, কাছে টেনেছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় প্রতিটি নদীর রয়েছে বাহারি সৌন্দর্য ও আলাদা সংস্কৃতি। এ দিক থেকে ভাবলে বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের প্রতিটি নদীরই রয়েছে অপার পর্যটন সম্ভাবনা। শুধু যথাযথ উদ্যোগ আর সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে নদীকেন্দিক পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে পারলে দেশের নদ-নদীগুলোই হয়ে উঠতে পারে পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু ও আকর্ষণের জায়গা। আয়তনের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান ৯০তম। এত কম আয়তনের একটি দেশে এত বেশি নদ-নদী বিশে^র আর কোনো দেশে আছে কি না সন্দেহ! কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সঠিক পরিচর্যা আর পরিকল্পনার অভাবে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। স্বাধীনতার আগে এ দেশে ৭০০টিরও বেশি নদ-নদী ছিল। দখল-দূষণ আর ভরাট হয়ে অনেক নদী ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। এখন নদ-নদীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২০টির মতো। টিকে থাকা বর্তমান নদ-নদীগুলোর অবস্থাও অত্যন্ত করুণ। অধিকাংশ নদ-নদী দূষণ আর দখলের কবলে পড়ে ধুঁকছে। নাব্য সংকটের কবলে পড়ে বহু নদী অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। এসব বিষয় নদীকেন্দ্রিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা এ দেশে এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি! যদিও জাতীয় সম্পদ নদ-নদীগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব সবার। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো নদ-নদীতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। শিল্প-কারখানার তরল ও কঠিন বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে নদী। নদীখেকোরা একটু একটু করে নদীর তীর ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করছে। ভরাট হয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলোর ড্রেজিং সময়মতো না করার ফলে কোনো কোনো নদী মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে ও হচ্ছে। দেশের নদ-নদীগুলোর এসব সমস্যা দূর করতে পারলে নদ-নদীগুলো রক্ষাসহ অপরিসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। শহরের মধ্যে অসংখ্য খাল আর চারপাশ নদী দ্বারা ঘেরা রাজধানী ঢাকার মতো এমন প্রকৃতি-পরিবেশসমৃদ্ধ শহর পৃথিবীতে বিরল! যদিও বেশ কিছু খাল ইতোমধ্যে দূষণ আর দখলের কবলে পড়ে ভরাট হয়ে হারিয়ে গেছে। ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোও দূষণ ও দখলের শিকার। শহরের মধ্যে এখনো যে খালগুলো টিকে রয়েছে, এগুলো দখল-দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে যথাযথ উদ্যোগ ও সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। দখল-দূষণ বন্ধ করে ঢাকাকে ঘিরে থাকা নদ-নদীগুলোয়ও পর্যটনের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানো যেতে পারে।

সহজ কথায়, নদ-নদীর প্রতি আরো যতœবান হতে হবে। এক একটি নদীকে ঘিরে পর্যটন ক্ষেত্র ও এর অন্যান্য সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে হবে। নদী-নদীর সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা তৈরি করতে হবে। সভ্যতার শুরু থেকে নদীর সঙ্গে মানুষের যে গভীর মিতালি ছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ নদীকেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ পারবে না কেন? তবে এ ব্যাপারে গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে করি। আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যোগাযোগ অর্থনীতি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের মূল ভিত্তি হলো নদী। নদী পর্যটন মূলত নদীর উন্নয়নের সাথে জড়িত। যেকোনো মূল্যে দেশের নদ-নদীগুলোকে দখল-দূষণ আর ভরাটের কবল থেকে রক্ষা করে টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হলে নদ-নদীগুলোও চিরস্থায়ীভাবে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে। এ ছাড়া নদীভিত্তিক ট্যুর প্ল্যান ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পর্যটন খাতে একটি নতুন মাত্রা যোগ হবে। এর ফলে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন খাত থেকে সরকার বিপুল রাজস্বও পাবে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চর, হাওর-বাঁওড়, সমুদ্রসৈকত, দ্বীপ, খাল-বিল ইত্যাদি সংরক্ষণ করা গেলে নদ-নদীর মতো ধীরে ধীরে এগুলোও টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close