আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

কবিতাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ

ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর বাংলা সাহিত্য নতুন বাঁক নেয়। কবিতাসাহিত্যে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। মহান ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন বা আগে পরের বিভিন্ন পরিক্রমার পর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছি। এ ক্ষেত্রে বাংলাসাহিত্যের কবিতার ভূমিকা অনেক। বিশেষ করে সত্তর দশকের কবিতায় পাকিস্তান শাসনবিরোধী অবস্থান বেশি ফুটে উঠেছে। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে কবির লিখিত বেশ কিছু কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাক-পরিবেশ ফুটে উঠেছে। প্রিয় মুক্তিযুদ্ধ মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে পূর্ণতা পায়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’Ñ এমন সুদৃঢ় অঙ্গীকার আর ভাষা শহীদদের প্রতি অনিঃশেষ ভালোবাসা নিয়ে বাংলা কবিতার স্বদেশপ্রেমে নতুন করে যাত্রা শুরু। এর মাধ্যমে সাধারণ আমজনতাকে সচেতন ও আন্দোলনমুখী করতে সহায়তা করেছে।

পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় (দেশ) মজলুম আদিব (যার অর্থ নির্যাতিত কবি) নামে কবি শামসুর রাহমানের কবিতা ছাপা হয়। তিনি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রƒপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর স¤পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ করে লেখেন অসাধারণ কবিতাÑ ‘টলেমেকাস’ (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে)। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানে কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসংগীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, যাতে আরো স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন ও ফজল শাহাবুদ্দীন।

বাংলা ভাষার ওপর বারবার হামলা করেছে বিদেশি শত্রুরা। বাংলা ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছে সময়ে সময়ে। পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান, যার প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালের আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও। কবি ক্ষুদ্ধ হয়ে লেখেন, ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।/মমতা নামের প্রতি প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়/ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে/শিউলি শৈশবে’ পাখী সব করে রব বলে মদনমোহন/তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,/অবিচ্ছিন্ন পর¯পর মমতায় লীন,/ঘুরেছি কাননে তাঁ নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই/ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে। আজন্ম আমার সাথী তুমি,/আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গড়ে পলে পলে,/তাই তো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে/আমারই বন্দরে’Ñ (বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা/সংক্ষেপিত)।

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।/বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে/নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো/হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষ্মতায়/বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট/উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন ¯েœহের বিন্যাসে।/ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শেভিত/মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট/শহরের প্রধান সড়কে/কারখানার চিমনি-চূড়োয়/গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে/উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে, চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।/ আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক;/আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’।

কবি নির্মলেন্দু গুণ খুব সুপটুভাবে কবিতায় সেই সময়কে ধরে রাখেন বাঙালিকে উজ্জীবনীরস সঞ্চার করে। সেদিনের সেই ঊনিশ মিনিটের অমর কাব্যধর্মী ভাষণের চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ আমাদের বলছেন, ‘তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,/হৃদয়ে লাগিল দোলা,/জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।/কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনাল তাঁর অমর কবিতাখানি :/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

শহীদ কাদরী ভিন্নধারার কবি। তিনিও কবিতা লিখলেন উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে, অন্যায় আর অবিচারের প্রতি তার কবিতায় যোগ হলো দৃপ্ত উচ্চারণ। যেমন ধরিÑ ‘মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক/কাচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ,/একফালি টিন,/ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ/ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো/এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই/প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরি করলো কয়েকটা অক্ষর/‘স্বা-ধী-ন-তা’।’ (নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে, শহীদ কাদরীর কবিতা)।

কবি রফিক আজাদ। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো বিকল্প নেই বলে উচ্চারণ করেছেন। তাঁর ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ’ কবিতায় বীরোচিত মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছেÑ ‘তোমার মুখে হাসি ফোটাতে দামি অলঙ্কারে সাজাতে/ভীরু কাপুরুষ তোমার প্রেমিক এই আমাকে/ধরতে হল শ হাতে মর্টার, মেশিনগান-/শত্রুর বাংকারে, ছাউনিতে ছুড়তে হল গ্রেনেড/আমার লোভ আমাকে কাপুরুষ হতে দেয়নি।’

সিকান্দার আবু জাফর এর অমর কবিতাÑ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই/আমাদের সংগ্রাম চলবেই/...প্রয়োজন হলে দেব

এক নদী রক্ত/হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত/অবিরাম

যাত্রার চির সংঘর্ষে/একদিন সে পাহাড় টলবেই/চলবেই চলবেই/জনতার সংগ্রাম চলবেই...।’-(সংক্ষেপিত)। পরে ক্ষোভের মাত্রা বেড়ে গেলো কবির। কবিতায় প্রকাশ করলেন শক্ত ভাষায়। উগরে দিলেন ক্ষোভ আর বঞ্চনা। আলটিমেটাম দিলেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতায় উচ্চারণ করলেন এভাবেÑ ‘তুমি আমার জলস্থলের/মাদুর থেকে নামো/তুমি বাংলা ছাড়ো।’

কবি হেলাল হাফিজ উদাত্ত আহ্বান করলেন তরুণদের-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। কারণ আমাদের মতো কবিও জানতেন তরুণসমাজকে ঘা মেরে জাগাতে হবে। স্বাধীনতার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। তরুণরাই কিন্তু আমাদের বিজয় ছিনিয়ে এনেছেনÑ ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ (সংক্ষেপিত)

হাসান হাফিজুর রহমানের স্মৃতি, তোমার আপন পতাকা, এখন সব শব্দই, আবু জাফর ওবায়দুল্লার আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, আহমদ রফিকের এ দেশ আমার স্বর্গ, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ছবি, ফজল শাহবুদ্দিনের এপ্রিলের একটি দিন

১৯৭১, বাংলাদেশ একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাকে, শহীদ কাদরীর নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে, ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায় বেলাল চৌধুরীর স্বদেশভূমি, মর্মে মর্মে স্বাধীনতা ইত্যাদি কবিতাসাহিত্যে স্বাধীনতা আর অনিয়মের কথা, বাঙালির ব্যথা-বেদনার কথা উচ্চারণ করেছেন কবিরা।

অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ অনেক টেনে এনেছেন। দৃপ্ত উচ্চারণ করেছেন পাকিস্তানি অনিয়ম ও অবিচারের বিপক্ষে। কবিতা আর ছড়াসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কে আল মাহমুদের ‘ক্যামোফ্লাজ’ কবিতাটি এখানে স্মরণযোগ্যÑ ‘জেনো, শত্রুরাও পরে আছে সবুজ কামিজ/শিরস্ত্রাণে লতাপাতা, কামানের ওপরে পল্লব/ঢেকে রাখে/নখ/দাঁত/লিঙ্গ/হিংসা/বন্দুকের নল/হয়ে গেছে নিরাসক্ত বিষকাঁটালির ছোট ঝোঁপ।’

শক্তিমাণ সাহিত্যিক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক-প্রবন্ধের পাশাপাশি রণাঙ্গণের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিতা রচনা করেছেন। ‘গেরিলা’ শিরোনামসহ সে সময়ের বেশ কিছু কবিতায় স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান ও বিভিন্ন অনুষঙ্গ কবিতায় উচ্চারণ করেছেন।

কবি রফিক আজাদের একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ কবিতাটি ঠিক এমন- ‘হাতিয়ার হাতে দুশমনের মোকাবেলা করলাম/বারুদের গন্ধ মাখলাম শরীরে/ক্রলিং করে শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়ে/টুকরো টুকরো করে দিলাম শত্রুর সোনালি স্বপ্নকে।’

কবিরা ছিলেন আন্তরিক। স্বাধীনতা ও পাক শাসনের বিরুদ্ধে উচ্চারণ ছিল রক্তজবার মতো। মুক্তিযুদ্ধ, কবি ও কবিতার কাছে পর¯পরে ঋণী; পর¯পর হয়ে ওঠে একে অপরের আত্মার আত্মীয়।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close