সাধন সরকার

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

ড্রেজিংয়ে প্রাণ ফিরে পাক

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। প্রায় ৫৭ হাজার বর্গমাইল জুড়ে নদ-নদীগুলো জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আমাদের নগর সভ্যতা নদীর পারেই গড়ে উঠেছে। নদী সরে গেলে নগর বন্দর মরে যায়। সেদিক থেকে ভাবলে নদীর আরেক নাম জীবন। আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথি।’ নদীমাতৃক দেশের সভ্যতা মূলত নদীর ওপর নির্ভরশীল। তাই দেশ বাঁচাতে হলে সবার আগে নদ-নদীগুলো বাঁচাতে হবে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোই আজ অস্তিত্ব সংকটে। অধিকাংশ নদ-নদী দূষণ, দখল আর ভরাটের কবলে পড়ে ধুঁকছে। দেশের অর্ধেকের বেশি নদ-নদী আজ নাব্য সংকটে ভুগছে। সরকারি হিসেবে, স্বাধীনতার আগে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ টিরও বেশি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর দেশে এখন নদ-নদীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০টি (যদিও বেসরকারি হিসেবে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ২৩০টির মতো)। ১৯৭১ সালে দেশে নৌপথ ছিল প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার। এখন আছে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার (যদিও শুষ্ক মৌসুমে তা ৪ হাজার কিলোমিটারে দাঁড়ায়)। দেশের নদ-নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, কমিশনসহ দেশি-বিদেশি আরো অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও নদ-নদীগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না! এ দেশের নদ-নদীগুলো কীভাবে দখল-দূষণের শিকার হচ্ছে, দখল-দূষণের সঙ্গে কারা জড়িত, নদীর তীর ভরাট করে কারা বালুর ব্যবসা করছে, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়। নদী দখল-দূষণ আর ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে যথাযথ নীতি ও বিধিমালা থাকলেও তা প্রয়োগ করা হয় না বললেই চলে! বিদ্যমান আইনে নদীখেকোদের কঠিন কোনো শাস্তি ও জরিমানা হয়েছে বলে জানা নেই!

পত্রিকার পাতা খুললেই নদী দখল-দূষণ আর ভরাটের খবর পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ। দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীগুলো যেমন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী দিয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার টন পলি এ দেশে এসে জমা হচ্ছে। আবার দেশের অভ্যন্তরে নদীবিধ্বংসী কার্যকলাপ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নদী দখলের ফলে নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীগুলো পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। একটি নদীতে হঠাৎ করে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায় না। বছরের পর বছর ধরে ভরাট, দখল আর পলি অপসারণ না করার ফলে একটি নদী ধীরে ধীরে মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়! বাস্তবতা বলে, নদীটির নাব্য সংকট দূর করতে যখন উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পলি পড়ে ও ভরাট হয়ে যাওয়া নদী যখন নাব্য সংকটে ভুগতে থাকে তখন কৃত্তিম উপায়ে খনন করেও নদীটিতে আগের মতো প্রাণসঞ্চার করা ও স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। এভাবে অনেক নদী মরণদশায় পরিণত হলেও যেন দেখার কেউ নেই! নদ-নদীর কান্না কেউ শোনে না। নদী খনন একটি চলমান প্রক্রিয়া। নদীগুলোতে সব সময় পলি পড়ে না। পলি পড়ার নিদিষ্ট সময়-অসময় আছে। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে নদী খননে জোর দিতে হবে। দেখা যায়, ভরাট হয়ে যাওয়া তথা নাব্য সংকটে ভুগতে থাকা সব নদ-নদী খননে একসঙ্গে প্রকল্প নেওয়া হয়। সব নদী যেমন একসঙ্গে ভরাট হয় না, তেমনি বিভিন্নভাবে ভরাট হওয়া বিভিন্ন নদীতে একসঙ্গে খনন কাজ করা ঠিক নাও হতে পারে। প্রত্যেকটি নদী খননে নদীটির গতি-প্রকৃতি, গঠন বিন্যাস, পলির উৎসসহ সার্বিক প্রতিবেশ-পরিবেশ ব্যবস্থার কথা মাথায় রাখতে হবে।

আমার গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষের শাখা নদীটি আজ মৃত। ছোট বেলায় যে নদীতে সাঁতার কাটতাম, মাছ ধরতাম সে নদীটি এখন পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে। ফলে আশপাশের গ্রামের মানুষের নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। নদীটির খননকাজে সরকার থেকে টাকা বরাদ্দ এলেও পরিকল্পিতভাবে খনন কাজ করা হয়নি। নদী খননের টাকায় কিছু কিছু লোকের পকেট ভারী হয়েছে কিন্তু নদীটি আর প্রাণ ফিরে পায়নি। এভাবে দখলে আর ভরাট হয়ে যাওয়া বহু নদ-নদী আজ ধুঁকছে। সরকার থেকে প্রতি বছর নদ-নদীগুলোর নাব্য সংকট নিরসনে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও তবু কেন ভরাট হয়ে নদীগুলোর অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে? শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথ নাব্য সংকটের কবলে পড়ে মাঝে-মধ্যেই ফেরি ও নৌ-চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। পলি অপসারণ না করতে করতে পদ্মা নদীর বিভিন্ন স্থানে ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা মোকাবিলা, নদীভাঙন রোধ, কৃষিকাজে সুব্যবস্থা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নদ-নদীগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে ড্রেজিং জরুরি হয়ে পড়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, দায়সারা গোছের কাজ করে খননকাজ শেষ করা হয়। আবার খনন করা পলি তথা মাটি বা বালু খননকৃত নদীর পাশেই রাখা হয় অথবা একস্থানের মাটি নদীর মধ্যেই অন্য স্থানে ফেলা হয়! নদী খননে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ বাস্তবায়নে নদ-নদীকেন্দ্রিক পানি ব্যবস্থাপনার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নদী পর্যটনের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাই ভরাট হয়ে নদ-নদীগুলোয় পরিকল্পিতভাবে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (গভীরভাবে

খনন) করতে হবে। নদ-নদীগুলোর ড্রেজিংয়ের ওপর খরচ বছরের পর বছর বেড়েই চলেছে। যথার্থভাবে এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে কি না সেদিকেও নজর রাখতে

হবে। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলেও এ দেশের নদ-নদীগুলো ক্ষতির শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত নৌ-ট্রানজিট প্রটোকলের আওতায় দুদেশের মধ্যে প্রায় ৪৭০ কিলোমিটার নৌপথ খননের কথা শোনা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নদী প্রতিবেশ-পরিবেশ ব্যবস্থার কথা মাথায় রাখতে হবে। নিজেদের স্বার্থেই নদ-নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। সর্বোপরি খননকৃত নদী ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close