অলোক আচার্য

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৮

মতামত

দেশে দেশে বিপন্ন মানবতা

মানবাধিকার শব্দটি কোন দেশে জন্মগ্রহণকারী কোন শিশুর প্রাপ্য অধিকারকে বোঝায়। এই প্রাপ্য অধিকারের সংজ্ঞা আবার মানুষ থেকে মানুষ ভিন্ন হয়ে থাকে। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের পর থেকে বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়ে একজন মানুষ এই অধিকারগুলো পাওয়ার অধিকার রাখে বলে এগুলোকে মানবাধিকার বলে। একজন মানুষের প্রাপ্য অধিকার বলতে বেশ কিছু মৌলিক অধিকারকে বোঝায়। তবে সত্যিকার অর্থে পৃথিবীর অনেক দেশেই আজ মানবাধিকার মারাত্বকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অধিকার ঘটে। যুদ্ধ বিগ্রহে যেসব দেশ বিপর্যস্থ সেসব দেশে মানবাধিকারের কোন বালাই নেই। অভিবাসীরা বিভিন্ন দেশে অমানবিক জীবনযাপন করছে। পৃথিবীতে বহু মানুষের নেয়া জন্মই যেন আজন্ম পাপ। নূন্যতম অধিকারগুলোও তারা পায় না। তাছাড়া জাতিতে জাতিতে-গোষ্ঠিতে গোষ্ঠিতে বিভেদ, যুদ্ধ, দাঙ্গা হাঙ্গামা লেগেই আছে। যখন কোন দেশে এরকম অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে তখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। খুব বেশি দুরে যাওয়ার দরকার নেই। মিয়ানমার থেকে যে লাখ লাখ মানুষ আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে নিজ দেশে তাদের অধিকার বলে কিছু ছিল না। সব হারিয়ে তারা আজ আশ্রিত। কোথায় মানবাধিকার? তাদেরও পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। নিজ দেশে নির্বিঘেœ জীবন যাপন করার কথা। অভিবাসন সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের সীমান্তে অভিবাসীদের ভিড় বাড়ছে। সাগরে নৌকায় দিনের পর দিন না খেয়ে থেকে ধুকে ধুকে মারা যায়। এভাবেই মানবতা আজ সারাবিশে^ নিজের অস্তিত্ত খুঁজে বেড়াচ্ছে। সবথেকে ভয়াবহ অবস্থা আজকের ইয়েমেনে। বিশ^ শিশুর জন্য নিরাপদ আশ্রয় নয়। আজও বিশে^ ক্ষুধা তৃষ্ণায় শিশুরা মারা যায়। বহু শিশু দুর্ভিক্ষের কবলে রয়েছে ইয়েমেনে। ইয়েমেনের এই অবস্থাকে ভায়াবহ বলা হচ্ছে। খাদ্যাভাব যে কতটা নিদারুণ তা এই বাংলার মানুষ ভালোভাবেই জানে। এই সোনার বাংলায় একসময় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষ আজ ইতিহাস। ভয়াবহ সেই দুর্ভিক্ষে খাদ্যাভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের প্রাণহানি হয়। যে ঘটনাকে ছিয়াত্তুরের মন্বন্তর বলা হয়। এরপরেও বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়। যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। সেসময় প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ মারা যায়।

দুর্ভিক্ষের মতো ঘটনা ঘটার জন্য কেবল সাময়িক খাদ্য সংকটই দায়ী নয়। মানুষের তৈরি করা লোভ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জেরে চলা যুদ্ধ বা এরকম কোন সংকট দীর্ঘদিন ধরে চললে দুর্ভিক্ষের মত মারাত্বক খাদ্যাভাব দেখা দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সেটাই স্বাভাবিক। সেই চলে আসা শাসক গোষ্ঠীর লোভ আর ক্ষমতার কারণেই শতাব্দীর ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষের মুখে আজকের ইয়েমেন। ইয়েমেনের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। সেখানে মানবাধিকার চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সচেতন পৃথিবীর মানুষের সামনেই এই ঘটনা ঘটছে। অসহায় শিশু খাবার না পেয়ে ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে। কেবল ইয়েমেন নয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে ক্রমেই আমালের মতো শিশুরা ভয়ংকর বিপদের মধ্যে রয়েছে। একদিকে বিশে^র বড় বড় ধনী দেশগুলো যখন প্রতিদিন খাবারের একটি অংশ নষ্ট করে তখন ইয়েমেন দুর্ভিক্ষে। বিশ^ বিবেক আজ বড় নিশ্চুপ মনে হয়। ইয়েমেনে বর্তমানে এক কোটি ত্রিশ লাখ মানুষ অনাহারের শিকার বলে সতর্কতা জানানো হয়েছে জাতিসংঘ থেকে। এছাড়াও ইয়েমেনে অন্তত ১৮ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের মতে, বর্তমান বিশে^র সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটছে ইয়েমেনে। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে যুদ্ধাবস্তা চলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের হামলায় সেখানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে বহু বেসামরিক মানুষ। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল,রাস্তাঘাট,বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র,পানি শোধন কেন্দ্রসহ সব ধরনের সেবামুলক স্থাপনা। সেখানকার শিশুরা জানে না তারা পরবর্তীতে কি খাবে অথবা তাদের সেই খাবার কি হবে বা কোন উৎস থেকে তাদের খাদ্য সরবরাহ হবে। হাসপাতালগুলোতে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা দিন পার করছে। ইয়েমেনের এই পরিস্থিতিতে খুব তাড়াতাড়িই এই যুদ্ধাবস্থা বন্ধ করা প্রয়োজন। না হলে দেশটি আগামী তিন মাসের ভেতর শতাব্দীর ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষের শিকার হতে পারে বলে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলো ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশে মানবতা চরম সংকটে রয়েছে। কতজন মানুষ সমভাবে তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে? কতজন মানুষ তার প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে বা স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে পারছে। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ষ্পষ্টভাবে দুটি শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে। এক শ্রেণি ক্রমাগতভাবে সম্পদের মালিক হচ্ছে বিপরীতে অন্যপক্ষ গরীব হচ্ছে। দেশের মাথাপিছু আয় ঠিক থাকলেও বা বৃদ্ধি পেলেও তার সুফল সব মানুষ সমানভাবে পায় কি না তা খোঁজ নেয়ার কেউ থাকে না। এটাই বৈষম্য। যখন বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে তখন ষ্পষ্টতই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। কারণ একপক্ষের জীবন কাটে আরাম আয়েশে অন্যপক্ষের জীবন কাটে নিদারুণ কষ্টে। পুঁজিবাদের সমস্যাই এটা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close