আলমগীর খান

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি

আমরা প্রায়ই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা শুনি। কেননা যার যার সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া আধুনিক দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতে প্রায় কারোরই টিকে থাকা সম্ভব না। আর দায়িত্বটাও যার যার। নিজের চরকায় তেল দেওয়া বা ‘বদলে যাও, বদলে দাও’-এর এই ধুরন্ধর ও কূপম-ূক সমাজব্যবস্থায় নিজের ভাগ্য নিজেকে পাল্টাতে হবে। যেন এখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। এই প্রচারক গোষ্ঠীর আদর্শ গুরু একসময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। তিনি সর্বপ্রথম আলোর মতো করে বলেছিলেন, ‘সমাজ বলে কিছু নেই।’ আছে কেবল ব্যক্তি পুরুষ ও নারী। প্রত্যেকে নিজে নিজে বদলে গেলেই জগৎ অটোমেটিক বদলে যাবে। আপ ভালো তো জগৎ ভালো। একই রকমে নিজ গরজে যার যার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে নিলেই সমাজ ও রাষ্ট্র বিদ্যুৎ গতিতে উন্নতি লাভ করবে!

শুভঙ্করের ফাঁকি এখানেই। চাইলেই প্রত্যেকে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে নিতে পারে না, যেমন চাইলেই নিজেকে বদলানো যায় না। বদলে যাওয়ার ও বদলে দেওয়ার কোনো ব্যক্তিগত সুইচ নেই। তবু আশার কথা হচ্ছে, এ জন্য একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুইচবোর্ড আছে। বদলানোর ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কলকাঠি বেশির ভাগ সেখান থেকে নড়ে। রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশ্নটিও তাই জরুরি। অথচ এ বিষয়ে আলোচনাটি সবচেয়ে কম হয়। এ কথা ঠিক, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে রাষ্ট্র তৈরি। এ জন্য আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন হলেই সমাজ ও রাষ্ট্র বদলে যায়। যেন রাষ্ট্র বলে কোনো কিছুর বাস্তব অস্তিত্ব নেই। ওটা ধোঁয়াশা, কাল্পনিক কিছু। আছে কেবল ব্যক্তি। যেন আছে কেবল পানির কণা, নদী বলে কিছু নেই! সেটা সত্যি হলে আমাদের জীবনকে পরিবর্তনের জন্য ব্রিটিশের কব্জা থেকে আমাদের রাষ্ট্রকে মুক্ত করার দরকার হতো না, বা পরে পাকিস্তানিদের হাত থেকে কেড়ে নিজেদের রাষ্ট্র নিজেদের হাতে নেওয়ার দরকার পড়ত না। এই দরকার হওয়ার কারণ রাষ্ট্রের একটা নিজস্ব মাধ্যাকর্ষীয়-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র আছে, যা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জীবনকে প্রভাবিত করে। সোজা কথায়, রাষ্ট্র ব্যক্তির যোগফল নয়, গুণফল বা তার চেয়ে বেশি। অতএব, রাষ্ট্রের চরিত্রে বা প্রকৃতিতে পরিবর্তন ব্যক্তিগত পরিবর্তনের চেয়ে বেশি জরুরি।

কেননা এই রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সক্ষমতা থাকা বা না থাকা অথবা কম বা বেশি থাকার ওপর ব্যক্তির ভাগ্য বহুলাংশে নির্ভর করে। অ্যারিস্টোটল যে বলেছিলেন, ‘মানুষ রাজনৈতিক জীব’ তার পুরো অর্থ এখনো আমরা তলিয়ে দেখিনি। তিনি তার ‘রাষ্ট্রনীতি’ বইতে রাষ্ট্রকে অকৃত্রিমভাবে গড়ে ওঠা একটা সত্তা হিসেবে দেখেছেন। তার মতে, যে ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রের সদস্য নয় সে হয় অমানুষ বা দেবতা। কেননা সমাজ ও রাষ্ট্র ছাড়া ব্যক্তি-মানুষ পূর্ণতা পায় না। মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি আর পশুপাখি যা বোঝে অর্থাৎ পশুপাখি মানুষকে যে চোখে দেখে তার মাঝে আকাশ-পাতালের পার্থক্য। পশুপাখির ওপরে অবস্থিত যে মানবসত্তা তা সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি। রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পূর্বাবস্থা সমাজ। এ সমাজ ও রাষ্ট্রকে মানুষের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। সমাজ ও রাষ্ট্রের মাঝেই মানুষ ব্যক্ত হয়ে ব্যক্তিতে পরিণত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের বাইরে মানুষ হিসেবে ব্যক্ত হওয়া অসম্ভব। ব্যক্তি জীবনের ওপর রাষ্ট্রের প্রভাব তাই বিরাট। আর ব্যক্তির মতো রাষ্ট্রও ভালো বা মন্দ, সক্ষম বা অক্ষম, সবল বা দুর্বল, ন্যায়পরায়ণ বা দুর্নীতিপরায়ণ, লুণ্ঠক বা কল্যাণকামী হতে পারে। শাসকগোষ্ঠীর কারণে।

রাষ্ট্রে শাসকচক্র সাধারণত এ সত্যটি জনগণের কাছ থেকে আড়াল করে রাখে। ‘আপ ভালো তো জগৎ ভালো’ কিংবা ‘বদলে যাও, বদলে দাও’-এর মতো আপাত মিষ্টি মিষ্টি মহামতাদর্শের গোপন পৃষ্ঠপোষক এই শাসকচক্র। ঠেলায় না পড়লে শাসকরা কখনো নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে চায় না। শাসন-রীতিনীতি, আইনকানুন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার যে অদম্য প্রভাব ব্যক্তি জীবনে পড়ে তা জনগণের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়। কাজটা করা হয় শ্রেণিস্বার্থে। মার্ক্সবাদীরা তাই রাষ্ট্রক্ষমতায় কেবল ব্যক্তির পরিবর্তনে কোনো পরিবর্তনই দেখে না। রাষ্ট্রক্ষমতার শ্রেণিগত হাতবদল ছাড়া রাষ্ট্রের চরিত্রে যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না, মার্ক্সবাদীরা তা যথার্থই বলে।

ব্যক্তিজীবনের বহু সমস্যার পেছনে রাষ্ট্রের কোনো সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা বিদ্যমান। রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে তার ভূমিকায় পরিবর্তন আনতে পারলে অনেক সংকট দূর করা সম্ভব। রাষ্ট্রকে অগ্রাহ্য করলে ব্যক্তির চেষ্টায় এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না, ব্যক্তিগত ক্ষণস্থায়ী সমাধান হবে মাত্র। আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনের সমস্যা ও সংকট দূর করতে তাই রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা ভাবতে হবে। রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি মানে পুলিশ ও জেলের সংখ্যা বাড়ানো নয়, নাগরিকের জীবনের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা। সম্প্রতি কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ ও ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির শিক্ষক আন্তোনিও স্যাভোয়া তাদের এক যৌথ লেখায় (কোনো দেশ কীভাবে দ্রুত দারিদ্র্য দূর করতে পারে?, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ১৫ নভেম্বর ২০১৮) দেখিয়েছেন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও কোনো রাষ্ট্রের অক্ষমতা কী রকম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আসাদুল্লাহ ও স্যাভোয়া লিখেছেন, ‘দারিদ্র্যের ভূগোল পরিবর্তনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করেছে। আফ্রিকায় রাষ্ট্রসমূহের দুর্বল অর্থনৈতিক ভূমিকাÑযার মূলে আছে সংঘর্ষ, অকার্যকর নীতি, জাতিগত খ-ীকরণ ও বাহ্যিক আঘাতÑদারিদ্র্য হ্রাসকরণ কর্মসূচিতে অর্থসংস্থান কঠিন করে তুলেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাষ্ট্রের সক্ষমতা। দুর্বল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ কার্যকরভাবে পণ্য ও সেবা জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে না।’

তারা আরো লিখেছেন, ‘তবু, দেশে দেশে পার্থক্যের কারণ যাই হোক, দারিদ্র্য হ্রাসে সাফল্যের জন্য একটা মূল উপাদান হচ্ছে রাষ্ট্রের সক্ষমতা। আমরা দেখেছি, এমডিজির কালে উচ্চ-দারিদ্র্যের দেশসমূহ সবল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সাহায্যে দুর্বল রাষ্ট্রের তুলনায় দ্বিগুণ গতিতে দারিদ্র্য হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। আর এমডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে সেসব দেশের সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি।’

তারা মনে করেন, এমডিজির কাল শেষে যে প্রায় ৭৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের মাঝে পড়ে আছে তারা মুক্তি পেতে পারে ‘কার্যকর রাষ্ট্র গঠনে বিনিয়োগ কর্মসূচি’র মাধ্যমে। তারা বলেন, ‘না হয় দারিদ্র্য দূরীকরণের শেষ তারিখটি অধরাই থেকে যাবে।’ অতএব, মানুষের জীবনের সমস্যা ও সংকট নিরসনে রাষ্ট্রকে কার্যকর ও সক্ষম করে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম। রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও অক্ষমতার ব্যাপারটি মোটেও হেলাফেলার নয়। অতএব সব মানুষের জীবনে কল্যাণ অর্জনে অনাকাক্সিক্ষত বিলম্ব দূর করে দ্রুত কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রের সক্ষমতা অর্জনের ওপর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close