সাধন সরকার

  ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮

প্রত্যাশা

ইশতেহারে গুরুত্ব পাক পরিবেশ

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে অংশগ্রহণকারী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করতে যাচ্ছে। আশা করি এসব ইশতেহারে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও পরিবেশগত অন্য সমস্যাসমূহ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকবে। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে কোনো দেশ-ই এখন নিরাপদ নয়। পৃথিবীব্যাপী প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এখন পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন দুটোকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবেশগত বিবেচনা না করে শুধু উন্নয়ন করলে সে উন্নয়ন টেকসই হবে না। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম সারিতে রয়েছে। জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জার্মানওয়াচ’ গত ১৯ বছর ধরে দুর্যোগের সংখ্যা, মৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতির মোট হিসাবের ভিত্তিতে ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকিসূচক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এবারও বাংলাদেশ ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। তবে শুধু গেল বছরের বিবেচনায় বাংলাদেশ রয়েছে ১৩তম অবস্থানে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে মোট ৮৫৯ জন মারা গেছেন। ওই সময়ে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি ডলার। আর মোট ১৮৭টি দুর্যোগ বাংলাদেশে আঘাত এনেছে। এসব দুর্যোগের মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধস প্রধান। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের বন্যা আগের চেয়ে তীব্র হচ্ছে। জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতাবিষয়ক আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্বন নিঃসরণকারী দেশসমূহ এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালের পর পৃথিবীর তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। মূলত জলবায়ুগত সমস্যার কারণে উন্নয়ন টেকসই ভিত্তি পাচ্ছে না। দারিদ্র্যদূরীকরণসহ অন্যান্য উন্নয়নে জলবায়ু পরিবর্তন বাধা হিসেবে কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার কারণে উপকূলীয় এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, বাড়ছে লবণাক্ততা। উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদীগুলোয় লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। ফলে বিভিন্ন কারণে মানুষ শহরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিষয়টির কথা ভাবতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় জলবায়ুগত দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, ভূমিধস, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে ব্যাপকভাবে ভুগতে হচ্ছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কমানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগ ও ট্রাস্টের যেসব প্রকল্প রয়েছে সেগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

দেশের নদ-নদীগুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। স্বাধীনতার পর অনেক নদ-নদী হারিয়ে গেছে। একসময় দেশে ৭২০টির বেশি নদ-নদী ছিল। এখন মাত্র ২৩০টির মতো নদ-নদী টিকে আছে। যে নদীগুলো টিকে আছে সেগুলোও আবার দখল আর দূষণের কবলে পড়ে ধুঁকছে। অধিকাংশ নদ-নদীর নাব্য সংকট রোধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নদীমাতৃক এ দেশের নদ-নদী না বাঁচলে বাংলাদেশের নামক ব-দ্বীপটার অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে। একেকজন সাংসদ যদি তার সংশ্লিষ্ট এলাকার একেকটি নদী রক্ষার দায়িত্ব নেয়, তাহলে নদ-নদীগুলো অন্তত দখল-দূষণের হাত থেকে বাঁচবে বলে মনে করি। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ ও পানিদূষণ সময়ের সাথে সাথে বেড়েই চলেছে। এসব দূষণে দেশের নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে ভুগতে হচ্ছে। আর্সেনিক দূষণে দেশের কোনো কোনো অংশের অধিবাসীকে মারাত্মকভাবে ভুগতে হচ্ছে। শহরাঞ্চলে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশ^ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে। বায়ুদূষণসহ সব ধরনের দূষণে শিশুদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দূষণজনিত রোগব্যাধি নগরবাসীর জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বায়ুতে যেসব ক্ষতির উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে ‘পিএম ২.৫’। এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সহজেই শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ ও হৃদরোগের পরিমাণ বাড়ায়। ‘পিএম ২.৫’- এর কারণে অ্যাজমা ও ফুসফুসের ক্যানসারও হতে পারে। ধুলাদূষণ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বর্তমান সময়ে ওজনস্তর ক্ষয় ও বৈশি^ক উষ্ণতার জন্য দায়ী এমন ক্ষতিকর গ্যাসসমূহ যেমন সিএফসি, এইচএফসি নির্গমনে করণীয় বিষয় ইশতেহারে থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। শহরাঞ্চলের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জোর দিতে হবে। প্লাস্টিক ও নিষিদ্ধ পলিথিন দূষণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ইশতেহারে থাকতে হবে। প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। বনভূমি বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। এ ছাড়া পাহাড়, বন রক্ষায় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। বৃক্ষরোপণসহ উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্মসূচিসহ জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশে পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হয় না। পরিবেশ সমস্যাবলি মোকাবিলায় নিরপেক্ষভাবে পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। ভালো হতো, যদি রাজনৈতিক দলগুলো পরিবেশসহ প্রত্যেকটি সুনির্দিষ্ট জাতীয় বিষয়গুলো নিয়ে টেলিভিশন বিতর্কে অংশগ্রহণ করত। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইশতেহারে থাকলেও নির্বাচনের পরে ইশতেহারের অনেক বিষয় ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকে! এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর আন্তরিক হওয়ার পাশাপাশি ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। আশাকরি, বর্তমান বাস্তবতার আলোকে আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ বিপর্যয়কারী অন্য বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close