মোতাহার হোসেন

  ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮

মতামত

পাটের জন্য চাই টেকসই ব্যবস্থাপনা

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের পাশে পাট সম্পর্কে নানা রকম ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন দেখে স্কুলশিক্ষার্থী ১২ বছরের রবিন তার মাকে প্রশ্ন করছে, আম্মু পাট নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর লেখা পড়লাম, এসব কেন? উত্তরে মা বললেন, পাট আমাদের অন্যতম অর্থকরী ফসল। একসময় এই পাট রফতানি করে আমাদের বহু বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। কিন্তু পরে যথাযথ উদ্যোগ না থাকায় পাটের সেই সুদিন অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার আবার পাটের সেই সুদিন ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। এ জন্যই রাজধানীর রাস্তায় ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন দিয়ে মানুষকে পাটের অতীত সম্পর্কে মনে করিয়ে দিচ্ছে। স্কুলছাত্রের মনে উদয় হওয়া এ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বদলে গেছে মূলত পাট সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির একটি প্রয়াস বলে মনে করেন রবিনের মা।

ইতোমধ্যে পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পাটপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার, চাল, আটা, চিনিসহ ১৮টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগের বাধ্যতামূলক ব্যবহার, পাট চাষে উৎসাহ দিতে চাষিদের প্রণোদনা, সরকারি উদ্যোগে পাট ক্রয়, পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় পাট খাতের সুদিন ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ খাতের উন্নয়নে তথা পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার সব রকম প্রস্তুতি এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

একসময় কৃষি ও অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল দেশের পাট শিল্প খাত। আবার সোনালি আঁশের সেই দিন ফিরিয়ে আনতে চায় সরকার। সরকারি হস্তক্ষেপে বর্তমানে পাটের উৎপাদনে গতি এসেছে। পাটজাত পণ্যের উৎপাদনও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। পাটকলগুলোতেও সরকারের রয়েছে বিশেষ নজর। আর আগামী জাতীয় পাট দিবসকে ঘিরেও চলছে বহুমুখী প্রস্তুতি। ২০১০ সালে সারা দেশে পাটের চাষ হয় সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে। ওই সময় পাটের উৎপাদন ছিল গড়ে ৭০ থেকে ৮০ লাখ বেল। এর পরের বছরগুলোর চিত্রও ছিল একই। তবে ২০১৭ সালে মোট ৮ দশমিক ১৭ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। এ বছর ৯২ লাখ বেলেরও বেশি পাট উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে তা হবে পাটের আবাদি জমি ও উৎপাদনের নতুন রেকর্ড।

দেশে পাটের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ খাতে গবেষণা বাড়ানো, নতুন পাটনীতি প্রণয়ন, জুটমিল করপোরেশনকে সংস্কারের আওতায় আনা, পাটপণ্যের ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে পলিথিনের ওপর ইকোট্যাক্স আরোপ ইত্যাদি উদ্যোগ নিয়ে সরকার কাজ করছে। পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি এসব পণ্য বিদেশে রফতানির দিকেও জোর দিচ্ছে সরকার। এর মাধ্যমে এ খাতের বিশাল বাজার তৈরি করে কর্মসংস্থান বাড়ানোরও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রফতানি বাজার সম্প্রসারণ, বৈদেশিক মুদ্রা আয়, পরিবেশ সুরক্ষা ও কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে পাট। তাই পাট নিয়ে গবেষণা করে এর বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের অংশ হিসেবে ব্যাগ ও বস্তার বাইরে এখন পাট দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুতা, স্যান্ডেল, রুমাল, কাপড়, বিছানার চাদর, টুপিসহ বিভিন্ন ধরনের শৌখিন সামগ্রী।

এর বাইরেও বিভিন্ন আসবাব, তৈজসপত্র, পোশাক, শীতবস্ত্র, সোফা, বিভিন্ন ধরনের কাগজ, হার্ডবোর্ড তৈরিতেও পাট ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব বলে বিশ্বব্যাপী এগুলোর চাহিদা বাড়ছে। বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক বা প্যাকেজিং করতে এখন পাটের ব্যবহার বেড়েছে অনেক। দেশের বস্ত্র কারখানাগুলোয় এখন তুলার সঙ্গে পাট মিশিয়ে সুতা তৈরি করা হচ্ছে। সেগুলো দিয়ে তৈরি হচ্ছে কাপড়। এসব কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, পাকিস্তান ও ফিলিপাইন বাংলাদেশ থেকে পাটের বস্তা কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। আর কাঁচা পাট রফতানিতে প্রবৃদ্ধি এখন ৪৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

পাটের ব্যবহার গত কয়েক বছরে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় পাটের ইতিবাচক দিক নিয়ে ভাবছে সরকার। এ কারণেই গত বছর থেকে সরকার জাতীয় পাট দিবস পালন করতে শুরু করেছে। দিবসটি পালিত হবে মার্চে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল সোনালি আঁশের সোনার দেশ, পাটপণ্যের বাংলাদেশ।

দেশে পাটের ব্যবহার ও রফতানি বাড়াতে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। কেবল রাজধানী নয়, জেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত পালিত হবে এসব কর্মসূচি। দেশে পাটের বাজার বাড়াতে ধান, গম, চাল, ভুট্টা, চিনি, মরিচ, হলুদ, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, আটা, ময়দা, খুদ, কুঁঁড়াসহ ১৭টি পণ্যের মোড়কে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাট খাতের উন্নয়নে সরকার পাট আইন-২০১৭ প্রণয়ন করেছে। বিশ্ববাজারে পাটকে তুলে ধরতে ২৩৫ ধরনের পাটজাত পণ্য উদ্ভাবন করেছে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)। পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় অভ্যন্তরীণ বাজারে এক শ কোটি পাটের বস্তার চাহিদা তৈরি হয়েছে। পাটচাষিদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি ‘বাংলার পাট বিশ্বমাত’ শীর্ষক সেøাগান নিয়ে পাটশিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারেও পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের আইন শতভাগ কার্যকর করা প্রয়োজন।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৯ দশমিক ৬২ লাখ বেল পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে সাত হাজার ২৯৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা আয় করেছে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের তুলনায় এর পরিমাণ ৮৭৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা বেশি। এ ছাড়া, বছরে ১২ লাখ বেল কাঁচা পাটও রফতানি হচ্ছে। পাটজাত পণ্যকে কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের তালিকাভুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পাটশিল্পের ব্লক ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করা হয়েছে। ইডিএফ ফান্ডের মতো পাটশিল্পের জন্য ২ ভাগ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল তৈরির বিষয়েও বিজেএমসির পাটকলগুলো ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯৫ হাজার টন পাটপণ্য উৎপাদন

করেছে। এই অর্থবছরে বিজেএমসির মোট আয় এক হাজার ১৫৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, ব্যয় এক হাজার ৮৫০ কোটি ৯ লাখ টাকা। গত অর্থবছরেও বিজেএমসির পাটকলের লোকসান ছিল ৬৯৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। তবে এ বছর তা অনেক কমে গেছে। এ বছর বিজেএমসির লোকসান ১৮০ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।

সরকার বিজেএমসির প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, পাট খাত পুনরায় দেশের মানুষ এবং অর্থনীতিকে নতুন করে আশার আলো দেখাবে। আর এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মহলকেও যথাযথ ভূমিকা নিতে হবে। সবার প্রচেষ্টায় পাট নিয়ে আমাদের অতীতে হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close