রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

নিরাপত্তা সংকটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ায়। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্যে তাদের অবদান মাত্র ৫ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক রাজনৈতিক অবিশ্বাসই এর মূল কারণ। সবাই-ই কম বেশি জানেন, চীন যেখানে মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথা বলে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলোকে কানেক্ট করতে চাইছে, সেখানে ভারত বলছে, ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডরের কথা। মূল প্রশ্ন একটাই ভারত মহাসাগরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। চীন-ভারত দ্বন্দ্ব সেখান থেকেই শুরু। শ্রীলঙ্কার পর মালদ্বীপে চীনের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছিল। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে। এর আওতায় চীন এসব দেশে অবকাঠামো খাতে ঋণ দিচ্ছে। যেমন মালদ্বীপের ‘চীন-মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ’-এর কথা উল্লেখ করা যায়। এ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ রাজধানী মালের সঙ্গে পাশের দ্বীপ হুলহুলেকে সংযুক্ত করেছে। দুই কিলোমিটার লম্বা এ ব্রিজ দিয়ে মাত্র ৫ মিনিটে রাজধানী মালেতে যাওয়া যায়। হুলহুলেতে প্রধান বিমানবন্দরটি অবস্থিত। মালদ্বীপ চীন থেকে প্রায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। যদিও নয়া সরকার এ ঋণ নিয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। চীনের বদলে এখন তারা ভারতীয় সাহায্য চাইছে। শুধু মালদ্বীপ আর শ্রীলঙ্কার কথা কেন বলি, নেপালের ক্ষেত্রেও চীন-ভারত দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায়। নেপালের বামপন্থি সরকার এখন চীনামুখী। চীন থেকে ব্যাপক সাহায্য আসছে নেপালে। মালদ্বীপের মতো পরিস্থিতি অনেকটা শ্রীলঙ্কায়ও। সেখানেও ভারত-চীন দ্বন্দ্বের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। ভারত-চীন দ্বন্দ্বের কারণে সেখানে বর্তমানে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের জন্ম হয়েছে। ওই সংকটের শুরু হয় যখন ২৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।

কিন্তু রাজাপাকসে ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল অবধি দুই দফায় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি অতি বেশিমাত্রায় চীনের প্রতি ঝুঁকে গিয়েছিলেন। চীনের অর্থে তিনি হামবানতোতায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছিলেন এবং সেখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরও তৈরি করা হয়েছিল। তিনি শ্রীলহলী অধিবাসীদের কাছে জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কেননা তিনি তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। তার অবদান ছিল তিনি দেশকে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু অতি চীনা নির্ভরতার কারণে ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। শুধু তা-ই নয়, তার শাসনামলে তিনি হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনকে ডকিং করার সুযোগ দিয়েছিলেন।অর্থাৎ হামবানতোতা

গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা সাবমেরিন সীমিত সময়ের জন্য ঘাঁটি গেঁড়েছিল। ভারত এটাকে দেখেছিল তার নিরাপত্তার প্রতি এক ধরনের হুমকি হিসেবে। ভারত কখনও চায়নি শ্রীলঙ্কা-ভারত সমুদ্রসীমানায় চীনা সাবমেরিন নোঙর করুক। ফলে রাজাপাকসেকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ভারতের জন্য। আর সে কারণেই ভারত রাজাপাকসের একসময়ের সহকর্মী সিরিসেনাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। অভিযোগ আছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনাকে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু নির্বাচনে হেরে গেলেও রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাননি রাজাপাকসে। তিনি আলাদা দল গঠন করে পার্লামেন্ট এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে তার অবস্থান শক্তিশালী করেছিলেন। কিন্তু তার ফল হয়েছে অন্যটা।

চলতি বছরের ১৮ নভেম্বর মালদ্বীপের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ শপথ গ্রহণ করেছেন। তিনি মালদ্বীপের সপ্তম প্রেসিডেন্ট। ২৩ সেপ্টেম্বর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন পরাজিত হন। এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছেÑ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি। নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি প্রমাণ করে ভারত মালদ্বীপের এ ক্ষমতার পরিবর্তনকে কত বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মোদি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ সফর করলেও মালদ্বীপ সফর করেননি। এর পেছনে কাজ করছিল সেই পুরোনো ভারত-চীন দ্বন্দ্ব। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন অতি বেশিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি বিমানবন্দর নির্মাণে ভারতীয় কন্ট্রাক্ট বাতিল করে চীনাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মালদ্বীপে চীনের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। স্ট্র্যাটেজিক্যালি মালদ্বীপের সমুদ্রসীমার গুরুত্ব বেশি থাকায় চীনের মালদ্বীপ সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ছিল। চীন মালদ্বীপে একটি নৌঘাঁটি করতে চেয়েছিল এমন খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ফলে সংগত কারণেই মালদ্বীপে চীনের নৌবাহিনীর সম্ভাব্য উপস্থিতিকে ভারত ভালো চোখে দেখেনি। ভারত এটাকে দেখেছিল তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে। তাই নির্বাচনে ইব্রাহিম সলিহর বিজয় এখন ভারতের জন্য একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে মালদ্বীপে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে। সলিহর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মোদির উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করল, ভারত এ সুযোগটি এখন তার স্বার্থে কাজে লাগাবে।

শুধু তা-ই নয়, এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে, মোহামেদ সলিহ তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ডিসেম্বর মাসে ভারত যাবেন। বলাই বাহুল্য, সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের আমলে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কে যথেষ্ট অবনতি ঘটেছিল। একপর্যায়ে মালদ্বীপে যে একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার বহর রয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন ভারতকে অনুরোধ করেছিলেন। মোদির এ সফরের মধ্য দিয়ে এমন একটি আশঙ্কা এখন তৈরি হয়েছে যে, ভারত এখন মালদ্বীপে তার সামরিক উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করবে। মালদ্বীপের নয়া নেতৃত্ব ভারতকে যে এখন কত বেশি গুরুত্ব দেয়, তার বড় প্রমাণ মোদিকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট আবদুল গাইয়ুম ও মোহাম্মদ নাশিদের উপস্থিতি। মোহাম্মদ সলিহ বিরোধী এমডিপি দলের সদস্য ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। নাশিদকে ভারতপন্থি হিসেবে অভিহিত করা হয়। মালদ্বীপে আপাতত ভারতপন্থিদের ‘বিজয়’ হলেও ভারত-চীন দ্বন্দ্বের কারণে মালদ্বীপের ভবিষ্যৎ একটা প্রশ্নের মাঝে থেকে গেল।অন্যদিকে বিক্রমাসিংহের সঙ্গে জোট করে সিরিসেনা ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি এ ঐক্যে ভাঙনে ধরে। সিরিসেনা অভিযোগ করেছিলেন, বিক্রমাসিংহের নীতির সঙ্গে তার দ্বিমত থাকার কথা। বিক্রমাসিংহ ছিলেন ভারতপন্থি। তিনি শ্রীলঙ্কার উন্নয়নের জন্য চীনের পরিবর্তে ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন। একসময় সিরিসেনা নিজেও ভারতপন্থি ছিলেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার উন্নয়নের জন্য, বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য তিনি চীনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার এ ‘চীনানীতি’ ও চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাকে ভারত ভালো চোখে দেখেনি।

এমনকি তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, এমন অভিযোগ সিরিসেনাকে উদ্ধৃতি করে ভারতীয় সংবাদপত্রে একটি সংবাদও ছাপা হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, সিরিসেনার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল এক পর্যায়ে তিনি রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলে ভারতপন্থিরা এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। সংকট সেখানে এখনও রয়ে গেছে। রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও সংসদের সমর্থন তিনি পাননি। এমনকি উচ্চ আদালত সংসদ বাতিল ও নয়া সংসদ নির্বাচনের ঘোষণাকেও অনুমোদন দেননি। পরিস্থিতি সেখানে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এ মুহূর্তে তা বলা কঠিন। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় এই যে পরিবর্তন, এর পেছনে কাজ করছে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব। মোদি ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে নতুন একটি নীতি প্রণয়ন করেন। এ নীতির মূল কথা হচ্ছে, নেইবারহুড ফার্স্ট অর্থাৎ প্রতিবেশীরাই অগ্রাধিকার পাবে বেশি। এ নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি ‘মনরো ডকট্রিন’র ভারতীয় সংস্করণ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। তার এ মতবাদের মূল কথা হচ্ছে ভারত মহাসাগর তথা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত অন্য কারও কর্তৃত্ব সহ্য করবে না। ২০১৫ সালের ২০ থেকে ২২ মার্চে ভুবনেশ্বরে আইওআরের শীর্ষ সম্মেলনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ওই সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ভারত এ অঞ্চলে অন্য কারও কর্তৃত্ব মেনে নেবে না। অর্থাৎ ভারত মহাসাগর ভুক্ত অঞ্চলের দেখ-ভাল করার দায়িত্ব ভারতের। এছাড়া জ্বালানি

তেলের ওপর চীন ও ভারতের নির্ভরতা বাড়ছে। ফলে ভারত মহাসাগরের নৌরুট ক্রমান্বয়ে ভারত ও চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

বিশ্বের কার্গো শিপমেন্টের অর্ধেক পরিবাহিত হয় এ ভারত মহাসাগর দিয়েই। একই সঙ্গে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৩ শতাংশের ২ শতাংশ এবং ৪ শতাংশের ৩ শতাংশ ট্রাফিক পৃথিবীর অন্যত্র যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানিকৃত পণ্যের তেলসহ ৯০ শতাংশ পরিচালিত হয় এ সমুদ্র রুট ব্যবহার করে। ফলে সমুদ্রপথের নিরাপত্তা চীন ও ভারতের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। চীন-ভারত দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় পরিবর্তন এসেছে। শুধু মালদ্বীপ আর শ্রীলঙ্কার কথা কেন বলি, নেপালের ক্ষেত্রেও চীন-ভারত দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায়। নেপালের বামপন্থি সরকার এখন চীনামুখী। চীন থেকে ব্যাপক সাহায্য আসছে নেপালে। চীন-ভারত দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ১০ জাতির আসিয়ান যেখানে বিশ্ববাণিজ্যে ২৫ শতাংশ অবদান রাখছে, সেখানে সার্ক তা ৫ শতাংশ ছাড়াতে পারেনি। এ অঞ্চলের দেশগুলোর দুর্বল বাণিজ্যিক বন্ধন তাদের সার্বিক বাণিজ্যের জন্যও একটি বাধা হয়ে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রতিযোগী ভারত গত বছর তাদের শীর্ষ ১৫ বাণিজ্য অংশীদারের কাছে ১৮৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা রফতানি করেছে, যা চীনের আট ভাগের এক ভাগ মাত্র। আঞ্চলিক বাণিজ্যের দুর্বলতায় দক্ষিণ এশিয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি একটি দুষ্টচক্রের মতো।

লেখক : বিশ্লেষক, গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close