মোতাহার হোসেন

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

‘রিয়েলি শেখ হাসিনা ইজ এ অ্যামেজিং উইমেন’

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘লেটস টক’-এর সৌজন্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে তার নিজের মুখেই অনেক অজানা তথ্য জানার সুযোগ হয়েছে নতুন প্রজšে§র। একই সঙ্গে কীভাবে তিনি রাজনীতিতে এলেন, ব্যক্তি জীবন, সংসার জীবনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অথচ ইতিহাসের বেশ কিছু সত্য, নির্মোহ অনেক উপাদন পাওয়া যাবে এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে। আবার যেসব তরুণ এই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার এবং প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছেন তাদের ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে প্রদত্ত কমেন্টসও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। এ রকমই একজন সিলেটের ফয়সাল খলিলুর রহমান। তার মন্তব্য হচ্ছে, ‘কাছ থেকে দেখা এবং শৈশব থেকে জীবনের প্রতিটি বাঁকের গল্প তার মুখ থেকে শোনার পর মনে হয়েছে, রাজনীতিতে সফলতার স্বাক্ষর রাখা এই নারীর (শেখ হাসিনার) জীবন ও বোধ বিস্ময় জাগানিয়া। ২৩ নভেম্বর শুক্রবার ওই সাক্ষাতের পর ফয়সাল ফেসবুকে এক পোস্টে পুরো অনুষ্ঠানের বয়ান ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন; যেখানে বঙ্গবন্ধুকন্যার শৈশব, কৈশোর, পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর তারুণ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বন্দিদশা, পঁচাত্তরে বিদেশ যাওয়া, বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হারানো, নির্বাসিত জীবন, রাজনীতিতে আসা এবং তার পরের সংগ্রাম ও দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। তার বর্ণনায়-‘হল রুমটাকে আরো আলোকিত করে ভোরের নরম আলোর মতো প্রশান্তির হাসি হেসে আসলেন শেখ হাসিনা। আসলে শেখ হাসিনা নতুন প্রজšে§র জন্য এক জ্বলন্ত ইতিহাস। একটি জ্বলন্ত বাতি যেমন অন্ধকারকে দূর করে চারপাশকে আলোকিত করে এবং নিজেও আলোকিত হয়Ñ শেখ হাসিনাও ঠিক তাই।

রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি খালাকে সেটে বসিয়ে নিজে সবার পেছনে চলে যান জানিয়ে ফয়সাল লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা চোখ উঠিয়ে কেমন যেন আহ্লাদি হয়ে উঠলেন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নুজহাত যখন জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন? এত মায়া নিয়ে তিনি উত্তরটা দিলেন, ‘আর কেমন থাকি বলো, বৃদ্ধ বয়সে আমার ওপর এত চাপ!’ তখন ফয়সালের অনুভূতি, আটপৌরে অভিমানী মায়ের মুখটা ভেসে উঠল। আসলে বাংলার সব মা এভাবেই কথা বলে। এরপর উপস্থিত তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তোমরা আমার নাতি-নাতনির মতো। তোমরা হইলা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ।’ কেমন ছিলেন কিশোরী শেখ হাসিনাÑদর্শক সারি থেকে এই প্রশ্ন পেয়ে তিনি যেন ওই বয়সীদের মতোই খিল খিল করে হেসে ওঠেন। ছোটবেলায় তিনি জাল দিয়ে মাছ ধরতেন, খালে ঝাঁপ দিয়ে গোসল করতেন। কি থ্রিলিং শৈশব! ঊাবা জেলে থাকতেন। তাই দাদা-দাদি খুব আদর করতেন খুকিটাকে। তারপর ৫৪ সালে তারা টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকা চলে আসেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা সভা থাকলে তিনি স্কুল পালাতেন। গাধা পিটিয়ে মানুষ বানানো হেড স্যার তাকে খুব আদর করতেন।

একবার ক্লাস সেভেনে ঢাকার বটতলায় কোনো একটি প্রোগ্রামে যেতে হবে। তো শেখ হাসিনা ও তার বন্ধুরা মিলে স্কুল পালানোর প্ল্যান করলেন। একজনকে ঠিক করলেন হেড স্যারের পাশের রুমে রাখা ঘণ্টাটা চুরি করতে। যেইনা ঘণ্টায় ঢং ঢং আওয়াজ হলো ছুটির আগেই হাসিনাসহ স্কুলের সবাই দৌড়ে পালাল। ‘রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম তার, সুতরাং ঘর থেকেই রাজনীতি শিখে শিখে বড় হচ্ছিলেন। পাকিস্তানিরা বাংলার ওপর উর্দু চাপিয়ে দিয়েছিল। একসময় নাকি আরবি হরফে বাংলা, পরে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রেশার দেওয়া হচ্ছিল। বাঙালি ছাত্রসমাজ কখনোই তা মেনে নেয়নি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর ৭১-এর আগ পর্যন্ত পুরো দেশ সংগ্রামে উত্তাল ছিল। আজ এই মিটিং তো কাল ওই মিছিল। শেখ হাসিনা তখন থেকেই ছাত্রলীগ করতেন।’...তিনি তখন ইডেন ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়তেন। পলাশীর মোড় হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রাজনীতি করতেন। একবার গন্ডগোল বেঁধে গেল। মুড়ির টিনের মতো বাসগুলোতে করে পুলিশ শেখ হাসিনাকে ধাওয়া করল এবং ধরে ফেলল, ‘এই মেয়ে সাহস তো কম না? মিছিল-মিটিং করো, জেলে ঢুকিয়ে দেব কিন্তু।’ শেখ হাসিনাও কম যান না, ‘আরে দিন না, জেলের ভয় দেখাবেন না। জেলে গিয়ে আমাদের অভ্যাস আছে।‘

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রসঙ্গে কিছু অজানা তথ্য ওঠে আসে শেখ হাসিনার কণ্ঠে। ৬ দফা ঘোষণার পর কলেজ সংসদের প্রতিনিধি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তবে তাতে বাদ সাধছিলেন মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি হাসিনাকে শক্ত করে বললেন, ‘নির্বাচন থেকে সরে আয়। তোর আব্বা ৬ দফা দিয়েছে। হেরে গেলে মনে করবে মানুষ বোধ হয় ৬ দফা চায় না।’ এদিকে হাসিনার বান্ধবীরা খুব করে ধরেছে, এ নির্বাচন থেকে সরে আসা যাবে না। আবার শাসক দল শেখ হাসিনাকে সামান্য কলেজের নির্বাচনে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। তারাও মনে করছে, শেখ মুজিবের মেয়ে জিতে যাওয়া মানে ৬ দফার প্রতি মানুষের সমর্থন। একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং কিন্তু মা ফজিলাতুন্নেছা ধমক দিলেন, ‘চুপ করে বাসায় বসে থাক। পলিটিকস করার দরকার নেই। মায়ের কথার প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না তরুণী শেখ হাসিনার। তিনি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। এ সময় গোপালগঞ্জ থেকে দাদা আসেন ঢাকায়। ‘দাদার কাছে ভেউ ভেউ করে কেঁদে হাসিনা বাইরে যাওয়ার আবদার করলেন। শ্বশুরকে বেশ সম্মান করতেন বেগম মুজিব। শ্বশুরের কথায় তিনি মেয়েকে ছাড়লেন, ‘কী আর করবি, যা ইলেকশন করে আয়।’ এ রকম প্রচ- প্রেশারের মধ্যে শেখ হাসিনা নির্বাচনে দাঁড়ালেন। উনার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর মোট ভোটের চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান পাস করলেন। প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধানমন্ডির বাসায় মা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে বন্দিদশার বিবরণও দিয়েছেন শেখ

হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি তখন প্রেগন্যান্ট। আমার পেটে আমার প্রথম সন্তান জয়। আব্বাকে পাকিস্তানে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় আর আমাদের একতলা একটা বাড়িতে বন্দি করে রাখে। আমার ভাই কামাল এক পাকিস্তানিকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। তখন আমাদের ওপর অত্যাচার আরো বেড়ে যায়। মা ডালে-চালে খিচুড়ি বানিয়ে রাখতেন। কিন্তু পেট ভরে কোনোদিন খেতে পারিনি। যার খিদা লাগত সে শুধু অল্প পরিমাণ খেতে পারত। জয়ের জন্মের সময় তাকে এক টুকরো নতুন কাপড় দিতে পারিনি। আমার এক বান্ধবীর বাচ্চার কাপড় ধার করে এনে তাকে পরিয়ে রাখতাম। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও আমাদের মুক্তি দেওয়া হয় ১৭ ডিসেম্বর। আমি আর মা বাসার ভেতর থেকে জয় বাংলা স্লোগান দিতাম। কি যে কষ্টে দিনগুলো কাটিয়েছি!’ তাকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন ফয়সাল।

এরপর ১৯৭৫ সালে স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার জোরাজুরিতে পরিবার ছেড়ে তার জার্মানি যাওয়ার কাহিনিও শুনিয়েছেন শেখ হাসিনা। সেখানে বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে অবস্থানের মধ্যেই ঢাকায় ঘটে যায় সেই ভয়াবহ ঘটনা। বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবাইকে হারান হাসিনা ও রেহানা। এক তরুণী কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘তারপর কী হলো? দেশে এলেন, দলের হাল ধরলেন কীভাবে? এত শক্তি কোথায় পেলেন আপা? আপনার কি ভয় লাগে না?’ শেখ হাসিনার টলমল চোখ আবার জ্বলজ্বল করে উঠল। তার পরিবারের নারকীয় হত্যার পর দুই বোনকে আশ্রয় দেন সিলেটের কৃতী সন্তান ও বিখ্যাত রাজনীতিবিদ হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। তারপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতায় দিল্লিতে আশ্রয় নেন। পরিবারে আদুরে ও আলসে বড় মেয়ে, যে কখনো ঘরে কাজ করত না, তাকে তখন সংসারের হাল ধরতে হয়। তখনি প্রথম ঝাড়ু দেওয়া শিখলেন তিনি। ১৯৮০ সালে তিনি গেলেন ইংল্যান্ড। বিদেশে ঘুরে ঘুরে নেতাকর্মী জোগাড় করলেন। অগোছালো আওয়ামী লীগকে শক্ত হাতে ধরলেন। ৮১ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরলেন। ফেরার আগেই হুমকি পেলেন, দেশে এলে গুলি করে মেরে ফেলব। বিমানবন্দরে আমরা ছুরি নিয়ে বসে আছি। এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার তো হারানোর কিছু নেই। তবে মরার আগে আমি মরতে চাই না। আমি কখনো নিজেকে নেতা ভাবতাম না। এখনো আমি নিজেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন কর্মী ভাবি।’

তার জীবনালেখ্য শুনে এটাই মনে হয়েছে, ‘রিয়েলি শেখ

হাসিনা ইজ এ অ্যামেজিং উইমেন’। তার তুলনা

তিনি নিজেই। তিনি একক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব, তরুণ প্রজন্মের আদর্শ এবং বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের একমাত্র আশা ভরসার স্থল।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close