রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০২ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

বিপর্যস্থ হওয়ার সম্ভাবনায় জার্মানি

কাগজে-কলমে জার্মানির অবস্থা এখন খুবই ভালো। ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি, যার প্রবৃদ্ধি বছরে ২ শতাংশ করে বাড়ছে। বেকারত্ব ঐতিহাসিক ভাবে সবচেয়ে কম। সরকারিভাবে যা ৪.৯ শতাংশ হলেও প্রকৃত বেকারত্ব এর চেয়ে বেশি। অর্থনীতিতে এ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনযাত্রা এখনও গড়পড়তা রয়ে গেছে। মিলিয়ন মিলিয়ন জার্মান শ্রমিকের চাকরি অনিয়মিত। ২০১৬ সাল থেকে ন্যূনতম আয় প্রতি ঘণ্টায় ৮.৮৪ ইউরো, যদি আপনি পূর্ণ সময় চাকরিরত থাকেন, তাহলে কর এবং সামাজিক বিমা বাদে এটি ঠিক ১ হাজার ৫০০ ইউরোর সামান্য কম দাঁড়ায়। দেশটিতে শ্রমজীবীদের অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হতে থাকলেও ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। ১৯১৩ সালের পর থেকে জার্মানিতে অসাম্য সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং সবচেয়ে দরিদ্রতম ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ২০ বছর আগে যে ক্রয়ক্ষমতা ধারণ করত তার চেয়ে অনেক কম ক্রয়ক্ষমতা এখন ধারণ করে। ঠিক একই সময় সরকার ভয়াবহ কৃচ্ছ্রসাধন করছে, রাষ্ট্রীয় ব্যয় অনেক কমিয়ে দিয়েছে অথচ দেশটি নিয়মিতভাবে উদ্বৃত্ত অর্জন করছে। তাই গণঅসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে। জার্মান চ্যান্সেলর ১ তার দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নের (সিডিইউ) নেতৃত্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আরও ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি আর নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। এর মাধ্যমে জার্মানিতে একটি যুগের অবসান ঘটবে। মার্কেল ২০০৫ থেকে জার্মানির চ্যান্সেলর এবং ২০০১ থেকে সিডিইউ’র নেতৃত্বে আছেন।

ঘোষণাটি এমন সময়ে এলো যখন দলটি এবং তার প্রধান জোটসঙ্গী ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন দুটি রাজ্য বাভারিয়া এবং হেসে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মারাত্মক ফল বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর প্রতি জনগণ আস্থা হারিয়ে এখন গ্রিন পার্টি এবং এএফডির দিকে ঝুঁকছে। শ্রমজীবী জনগণ যারা এসপিডি এবং সিডিইউ’র ভোটার ছিল তাদের অনেকেই এখন গ্রিন পার্টির দিকে তাদের সমর্থন ঘুরিয়ে নিয়েছে। গত বছর তারা জাতীয় নির্বাচনে ৮.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এখন তারা আঞ্চলিক নির্বাচনগুলোতে ২০ শতাংশ ভোট পাচ্ছে। আর যেসব উদারনৈতিক এবং খ্রিষ্টান ভোটার সিডিইউ ও সিএসইউকে ভোট দিত তাদের একটা বড় অংশ এএফডিকে বেছে নিচ্ছে। অভিবাসন জার্মান শ্রমিক-শ্রেণির জন্য প্রকৃত সমস্যা নয়। মর্কেল ২০১৫ সাল থেকে ১ মিলিয়ন অভিবাসী গ্রহণ করার পরও বেকারত্ব ২ শতাংশ কমে গিয়েছে এবং অপরাধপ্রবণতা ১৯৯২ সালের পর থেকে সবচেয়ে কম। জার্মান সমাজের মূল অপরাধ সংঘটিত করছে ওই দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি। কিন্তু উগ্র ডানপন্থি এএফডি তাদের দিকে সমালোচনার তির না ছুড়ে অভিবাসীদের ঘাড়ে সব দোষ চাপাচ্ছে। এতে শ্রমিক শ্রেণি বিভক্ত হয়ে পড়ছে এবং তাদের লড়াইয়ের মাত্রা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক নির্বাচনে সিডিইউ ২৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে, যা ২০১৩ সালের তুলনায় ১১ শতাংশ কম। ১৯৬৬ সালের পর এটাই দলটির সবচেয়ে বাজে ফল। মার্কেলের মিত্র ভলকার বুফর কোনোরকমে পরবর্তী আঞ্চলিক সরকার গড়ার ম্যান্ডেট পেয়েছেন। সিডিইউ’র দুর্বল মিত্র সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা খুবই বাজে ফল করেছে। তাদের ভোট ১১ শতাংশ কমে গিয়ে ১৯.৮ শতাংশ হয়েছে। ১৯৪৬ সালের পর থেকে সবচেয়ে বাজে অথচ এলাকাটি একসময় লাল দুর্গ বলে পরিচিত ছিল। উদারনৈতিক গ্রিন পার্টি, যারা হেসে সিডিইউ’র আঞ্চলিক সহযোগী হিসেবে পাঁচ বছর স্থায়ী ছিল, তারাই সবচেয়ে ভালো ফল করেছে। তাদের ভোট ৮ শতাংশ বেড়ে ১৯.৮ শতাংশ হয়েছে। উগ্র-ডানপন্থি অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি চতুর্থ অবস্থানে আছে। তারা ১৩.১ শতাংশ ভোট পেয়ে হেসে প্রথমবারের মতো একটি আসন পেয়েছে। বামপন্থি দল ডি লিঙ্ক পেয়েছে ৬.৩ শতাংশ ভোট।বাভারিয়াতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে সিএসইউ বরাবরই বড় ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে থাকে। তারা এবার ৩৭ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। ১৯৫৭ সালের পর থেকে এটাই তাদের সবচেয়ে বাজে ফল। এখানে এসপিডির বড় ধরনের পরাজয় ঘটেছে। তারা পেয়েছে মাত্র ৯.৭ শতাংশ ভোট। এ ফল যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বড় ধরনের সংকটে ফেলে দিয়েছে। জার্মানির জনগণ প্রতিষ্ঠিত দলগুলোকে এখন আর পছন্দ করছে না। তারা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরোধিতা করছে।এদিকে মর্কেল ২০১৫ সালে এক মিলিয়ন উদ্বাস্তু অধিগ্রহণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা শুধু উগ্র-ডানপন্থি এফডিকে লাভবান করেনি, পাশাপাশি তার দলের মধ্যেও বিভেদ তৈরি করেছে। এমনকি মর্কেলের জোটে তার দল সিডিইউ এবং সিএসইউ’র মধ্যেও দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। গত গ্রীষ্মে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী হোস্ট সিহোফের, যিনি আবার সিএসইউ’র নেতা। তিনি হুমকি দিয়েছেন, মর্কেল যদি সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ না করেন, তাহলে তার দল যুক্তফ্রন্টের সরকার থেকে বেরিয়ে যাবে।

উল্লেখ্য, দল দুটির মধ্যে যে দূরত্ব দেখা দিয়েছে, তা উগ্র-ডানপন্থি এএফডিকে লাভবান করেছে। প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর প্রতি সাধারণ জার্মান জনগণের এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। জার্মান একত্রীকরণের সময় থেকে সিডিইউ এবং এসপিডি মিলে ৬০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট পেত, এমনকি ১৯৭০ সালে এই প্রাপ্ত ভোট ছিল ৯০ শতাংশ। সাম্প্রতিক আঞ্চলিক নির্বাচনের এ ফলে সব সরকারি দলই বিপর্যস্ত। বিশেষ করে জার্মানির অর্থনৈতিক কেন্দ্র ফ্রাঙ্কফুর্টে এর প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। আর কয়েক সপ্তাহ আগে বুন্দেসদিগায় নিম্নকক্ষের নেতা নির্বাচনে যে ঘটনা ঘটেছে, তা মর্কেলের জন্য নেতিবাচক। তার দীর্ঘদিনের মিত্র ভলকার কুডর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সিডিইউ এবং সিএসইউ সংসদ সদস্যদের অভ্যুত্থানে পরাজিত হয়েছেন। সিডিইউ’র নেতৃত্ব নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরে। এরই মধ্যে মর্কেল যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে তার দলের নেতারা সিডিইউ’র চেয়ারম্যান পদে নতুন কাউকে বেছে নেবেন। সবচেয়ে বেশি যার নাম শোনা যাচ্ছে, তিনি হলেন ফ্রেডরিক মের্জ, যিনি ২০০২ সালে নেতৃত্ব প্রতিযোগিতায় মর্কেলের কাছে পরাজিত হন। তিনি ২০০৯ সালে হতাশ হয়ে তার বুন্তেসদিগার আসন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। জার্মান পুঁজিপতি এবং ডানপন্থিদের কাছে তিনি সমান জনপ্রিয়। তার ফলে জার্মানির রাজনীতিতে এক ধরনের অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে। সিডিইউ’র জোটসঙ্গী এসপিডির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট এ দলটি শ্রমজীবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার দাবি করলেও সিডিইউ’র ছায়ায় তাদের জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপই নিতে পারেনি।

২০১৭ সালের বুন্দেসদিগার নির্বাচনে তারা ২০.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, যা ১৯৩২ সালের পর থেকে সবচেয়ে কম। নির্বাচনে পরাজয়ের পর তাদের একজন নেতা শুলজ ক্ষমতাসীন জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যা একটি স্বতন্ত্র বাম শক্তির অভ্যুদয় ঘটানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু এ সম্ভাবনা ফিকে হয়ে যায়, যখন তাদের বাকি শীর্ষ নেতৃত্ব এ সিদ্ধান্তের বিপরীতে অবস্থান নেন। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে মারাত্মকভাবে এর প্রভাব পড়ে। তারা ১৪ শতাংশের কম ভোট পায়। আবার গ্রিন পার্টি যারা ইউয়ের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে তারাও প্রকৃত সমস্যাকে আড়াল করছে। ইউ ইউরোপিয়ান পুঁজিপতি শ্রেণি, বিশেষ করে বৃহৎ জার্মান ব্যবসায়ীদের অস্ত্র। তারা ইউরোপিয়ান বাজারে সস্তা পণ্যের বন্যা বইয়ে দিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ছে এবং একইসঙ্গে সস্তা শ্রম আমদানি করছে। জার্মানির পুঁজিপতি শ্রেণি ইউনিয়নবিরোধী এবং কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করে উচ্চ প্রশিক্ষিত জার্মান শ্রমিকদের সস্তা শ্রমে কাজ করার ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করছে। এর মাধ্যমে তারা রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা লাভ করছে অথচ অধিকাংশ জার্মানের জীবনযাত্রার মান নিম্নতর হচ্ছে। জার্মানিতে এমন কোনো বামপন্থি দল নেই, যাদের পুঁজিপতি শ্রেণির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে এবং সমাজের সাম্য প্রতিষ্ঠায় তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কর্মসূচি গ্রহণ করবে। ডি লিঙ্ক নামে বুন্দেসদিগায় একটি বামপন্থি দল নিজেদের সমাজতন্ত্রী হিসেবে দাবি করলেও তার প্রকৃত অর্থে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট।

তারা সংস্কারপন্থি কিছু দাবি করলেও ব্যাঙ্ক, মনোপলি, ব্যক্তিমালিকানাধীন গৃহায়ণ সংস্থা এবং বৃহৎ ভূস্বামীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও জাতীয়করণের কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। আগে এদের কিছুটা শক্তি থাকলেও এবং তিনটি আঞ্চলিক সরকারে মন্ত্রী থাকলেও এরা মূলত ক্ষমতাসীন মহাজোটের পুঁজিবাদী নীতিরই সমর্থক। সাম্প্রতিক সময়ে তারা এএফডির উত্থানে বিপর্যস্ত। জার্মানিতে এখন শ্রেণিদ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে জার্মান একত্রীকরণের ফলে যে রাজনৈতিক ভারসাম্য গড়ে উঠেছিল, তা এখন বিপর্যস্ত, যা স্থিতিশীল এবং সমৃদ্ধ জার্মানিকে অস্থিতিশীলতা, সংকট এবং তীব্র শ্রেণিসংগ্রামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশটির শাসক শ্রেণি এ আসন্ন বিপর্যয় এবং অনিয়ন্ত্রিত সংকট এড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা তাদের রপ্তানির প্রধান বাজার ধরে রাখার জন্য যে-কোনো মূল্যে ইউয়ের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু সমস্যার জটের সমাধান হচ্ছে না। বরং সমস্যা আরও তীব্রতর হচ্ছে। ক্ষমতাসীন জোটের মধ্যে সংকট আরও তীব্রতর হচ্ছে। ২০২১ সালের বসন্তে নির্বাচনের আগে মর্কেল চ্যান্সেলর পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন এবং তার ফলে জোট ভেঙে যেতে পারে। যদি সিডিইউ মর্কেলবিরোধী নেতৃত্ব নির্বাচন করে এবং এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এসপিডি জোট থেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে জার্মানির অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিপর্যস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে

লেখক : বিশ্লেষক, গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close