রেজাউল করিম খোকন

  ২০ নভেম্বর, ২০১৮

নাগরিক বিনোদন

পালাবদলের প্রকাশ সিনেপ্লেক্স

একসময়ে নাগরিক বিনোদনে সিনেমাই ছিল প্রধান অবলম্বন। সিনেমা হলগুলো ছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। তখনো এ দেশে টেলিভিশনের প্রচলন হয়নি। সিনেমা হলে গিয়ে লাইন ধরে টিকিট কিনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে সিনেমা দেখাটা ছিল রুটিনমাফিক কাজ। অনেক পরিবারে সিনেমা দেখার জন্য প্রতি মাসে আলাদা বাজেট বরাদ্দ থাকত। কাক্সিক্ষত সিনেমাটি সিনেমা হলে মুক্তি পেলে দলবেঁধে পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতেন কর্তা কিংবা গিন্নি। অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা উপভোগ করতেন। প্রিয় নায়ক-নায়িকার সিনেমাটি দেখতে বসে দর্শক হারিয়ে যেতেন অন্য এক ভুবনে। আবিষ্ট হয়ে উপভোগ করতেন পুরো সিনেমাটি। সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পরও আনন্দের রেশ কাটত না। অনেকেই গুন গুন করে গাইতেন সিনেমায় দেখা জনপ্রিয় গানটি। সিনেমার নানা বিষয় নিয়ে বাড়িতে, পাড়ার-আড্ডায় চলত আলোচনা-সমালোচনা। সিনেমা দেখার টিকিট সংগ্রহ করতে অনেক আগে থেকে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়াতে হতো। খুব ভালো সিনেমা হলে তার টিকিট জোগাড় করাটাও ছিল কঠিন কাজ। তখন কয়েক গুণ বেশি দামে কালোবাজারির কাছ থেকে টিকিট কিনে সিনেমা দেখে তারপর বাড়ি ফিরেছেনÑএমন উৎসাহী সিনেমা দর্শকের সংখ্যাও কম ছিল না।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সিনেমা ব্যবসায় রমরমা ভাবটি বেশ বজায় ছিল। সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়ছিল তখনো। কারণ এ দেশের মানুষ তখনো সিনেমা দেখাটাকে বিনোদন লাভের প্রধান উপায় হিসেবে বিবেচনা করতেন। সুস্থ বিনোদনের প্রকাশ ছিল আমাদের বাংলা সিনেমা। কিন্তু অশ্লীলতা, রুচিহীনতা, অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের বাংলা সিনেমা যখন থেকে কলুষিত হতে শুরু করে, তখন থেকেই সিনেমার দর্শক কমতে শুরু করেছে। দর্শক পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখতে বিব্রত বোধ করার পর থেকে তারা সিনেমা হলে যাওয়া ছেড়ে দিতে শুরু করে। দর্শক সংখ্যা কমতে শুরু করায় একসময়ে আমাদের সিনেমা ব্যবসায় চরম ধস নামতে শুরু করে। সিনেমা হলের পরিবেশও ক্রমেই অবনতির চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সিনেমাপ্রেমী দর্শকের অভাবে সিনেমা হলগুলো খাঁ-খাঁ করতে থাকে। এভাবেই দর্শকের অভাবে একে একে বন্ধ হয়ে যায় দেশের হাজার হাজার সিনেমা হল। বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত সিনেমা হলগুলো ভেঙে কিংবা আঙ্গিক পরিবর্তন করে সুপার মার্কেট অথবা শপিং মলে রূপান্তর করা হয়েছে গত এক দশকেরও বেশি সময়ে। এভাবেই বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় সিনেমা হল। ফলে শহরের বড় বড় সিনেমা হলগুলো দর্শকশূন্য থাকছে সব সময়। তবে সময়ের বিবর্তনে রাজধানী ঢাকা শহরে বিনোদন কেন্দ্রের ধরন ও রূপ বদলেছে। বড় বড় সিনেমা হলের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক দর্শক আসনবিশিষ্ট ছোট আকারের সিনেপ্লেক্স চালু হয়েছে। একই ছাদের নিচে কিংবা একটি নির্দিষ্ট কমপ্লেক্সে একসঙ্গে তিন-চারটি সিনেপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। যেখানে পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে। দর্শক তার রুচি ও পছন্দমাফিক সিনেমাটি উপভোগের জন্য যেকোনো একটি সিনেপ্লেক্সে টিকিট কেটে ঢুকে পড়ছেন। অপেক্ষাকৃত ছোট আয়তনের হওয়ায় সীমিতসংখ্যক দর্শকের জন্য সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে প্রতিটি সিনেপ্লেক্সে। চমৎকার ছিমছাম সুন্দর আকর্ষণীয় পরিবেশ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা, উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারে মনোমুগ্ধকর সিনেমার প্রদর্শন দর্শকদের জন্য অসাধারণ কিছু বয়ে না আনতে পারলেও বিনোদন লাভের ক্ষেত্রটিকে দারুণভাবে প্রশস্ত করেছে।

আজকাল ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটি সিনেপ্লেক্স চালু হওয়ার পর থেকে সিনেমা দর্শকের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। সিনেপ্লেক্স ধারণাটি আধুনিক মেট্রোপলিটন কসমোপলিটন নাগরিক জীবনে একটি প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সাধারণত ভদ্র, রুচিশীল, শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শক এবং তরুণ প্রজন্মের তরুণ/তরুণীরা সিনেমা উপভোগের জন্য সিনেপ্লেক্সগুলোকে বেছে নিচ্ছেন সেখানে। ফলে এখানকার দর্শকের রুচি ও পছন্দের কথা বিবেচনা করে সিনেপ্লেক্সগুলোয় সিনেমা প্রদর্শণীর আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ উন্নত পরিবেশের বেশ কিছু সিনেপ্লেক্স চালু হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে আলাদা দর্শকশ্রেণি গড়ে উঠেছে। নাগরিক জীবনযাপনে সিনেপ্লেক্সগুলোকে কেন্দ্র করে ভিন্ন এক সাংস্কৃতিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে দর্শকদের সর্বোচ্চ বিনোদন দেওয়ার নানা আয়োজন থাকছে। ডিজিটাল ডলবি সাউন্ড সিস্টেম, থ্রিডি থিয়েটার ব্যবস্থা প্রভৃতি সিনেপ্লেক্স কালচারে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে সন্দেহ নেই।

যারা একবার সিনেপ্লেক্সে গিয়ে ছবি দেখছেন, তাদের রুচি ও পছন্দ বদলে যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল হলেও সাধারণ সিনেমা হলের অনুন্নত পুরনো মান্ধাতার আমলের প্রজেকশন সিস্টেম, ঝাপসা অস্পষ্ট ছবি ভ্যাপসা অস্বস্তিকর পরিবেশ, অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন ভাঙাচোরা আসন, ছাড়পোকার কামড় ইত্যাদির চেয়ে সিনেপ্লেক্সে সিনেমা উপভোগ করাটাকেই বেছে নিচ্ছেন অনেক দর্শক। আরামদায়ক উন্নত পরিবেশে আধুনিক রুচিসম্মত সিনেমা উপভোগের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে সিনেপ্লেক্সগুলো। আরামদায়ক সুপ্রশস্ত আসন, চমৎকার উন্নতমানের সাউন্ড সিস্টেম এবং দর্শকদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য রুচিসম্মত ব্যবস্থা সিনেপ্লেক্সগুলোকে আকর্ষণীয় করেছে সন্দেহ নেই। শহরের ভদ্র রুচিশীল আধুনিকমনস্ক সিনেমা দর্শক আজকাল প্রায়ই ভিড় করছেন সিনেপ্লেক্সগুলোয়। এখানে টিকিটের দাম কিছুটা বেশি হলেও দর্শক সিনেমা দেখে বেশ মজা পাচ্ছেন। আনন্দময় মজার অনুভূতি নিয়ে সিনেপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে আসছেন। আরামদায়ক পরিবেশ এবং উন্নত প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার সিনেপ্লেক্সে সিনেমা উপভোগের স্বাদটাই পাল্টে দিয়েছে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে। এভাবে শহরে আরো সিনেপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দর্শকদের আকৃষ্ট করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় এবং আন্তরিক হতে হবে।

দেশজুড়ে সিনেমা হলের দর্শক কমে যাওয়ায় এ ব্যবসায় ধস নেমেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে হাজার হাজার সিনেমা হল। বিনোদনপিয়াসী দর্শকদের আবার সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহী এবং আকৃষ্ট করে তুলতে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহের মতো বড় শহরগুলোতে এবং পর্যায়ক্রমে আগামীতে অন্য শহরগুলোয় সিনেপ্লেক্স স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ধ্বংসপ্রায় চলচ্চিত্র শিল্প আবার চাঙা হয়ে উঠতে পারে। দেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি সব শ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয় বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে সিনেপ্লেক্সগুলো শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে, আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : ব্যাংকার

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close