অলোক আচার্য

  ১৯ নভেম্বর, ২০১৮

বর্ণবাদ

একই তিমিরে দৃষ্টিভঙ্গি

কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভেতরে সবার সমান রাঙা-মানুষ জাতি কবিতায় মানুষের ভেদাভেদ দূর করে সব মানুষকে সমান বানিয়েছেন। বর্ণবাদ শব্দটি দ্বারা মূলত শরীরের রং দ্বারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বোঝায়। সেই অতীতকাল থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক সমাজেও বর্ণবাদ আমাদের অস্থিমজ্জায় গেঁথে আছে। আমরা সম্ভবত এই বর্ণবাদের বিষয়টি পুরোপুরি দূর করতে চাই না। সাদা চামড়া কালো চামড়া নিয়ে সারা পৃথিবীতেই এক অদ্ভুত বৈষম্য চালু ছিল একসময়। কালো চামড়ার লোকদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রভু আর ভৃত্যেও সম্পর্ক ছিল কেবল গায়ের রঙের ওপর ভিত্তি করে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে উপন্যাস ও সিনেমা। নেলসন ম্যান্ডেলা নামটি আজ সবার কাছে পরিচিত। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন এই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। তার জন্য তাকে কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি। অদ্ভুত সব বৈষম্যে ভরা এ সমাজটা। এখানে চামড়ার রঙে বৈষম্য, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য, গোত্রে গোত্রে বৈষম্য, আকারে বৈষম্য, আর্থিক ক্ষমতায় বৈষম্যÑএ রকম আরো বহু বৈষম্য আমাদের এই সুন্দর ধরণীতে। অথচ কী আশ্চর্য মিল সবার মধ্যে! সবাই এই পৃথিবী নামক গ্রহটির মানুষ বলে পরিচয় দিই। আমাদের সবার দেহ একই রকম উপাদানে গঠিত, রক্তের রং লাল, খাদ্য খেয়ে সবাই জীবন ধারণ করি, গঠন-প্রকৃতিও এক। তবু আমরা বৈষম্য করি, নিজেদের আলাদা করে চেনানোর চেষ্টা করি, নিজেদের বিরত্ব জাহির করি।

উইকিপিডিয়ায় দেখা যায় বর্ণবাদ সম্পর্কে সেখানে বলা হয়েছে, বর্ণবাদ সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ, যেখানে বিশ^াস করা হয় যে, মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং একই সঙ্গে বিশ^াস করা হয় কোনো কোনো গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য। তবে বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। কারণ গবেষকদের মধ্যে গোষ্ঠী ধারণাটি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বর্ণবাদ কখনো গায়ের রং, কখনো আঞ্চলিকতা আবার কখনো গোত্র নিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত নেতা ও আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অন্যতম নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। যে মানুষটি এই বৈষম্য দূর করতে বহু নির্যাতন সহ্য করেছেন। ১৯৬২ সালে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার গ্রেফতার করে, অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার শে^তাঙ্গ সরকার সে সময় একটি আইন প্রণয়ন করেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গদের সব সময় তাদের পরিচয়সংক্রান্ত নথিপত্র বহন করতে হবে। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে জড়ো হন কৃষ্ণাঙ্গরা। পুলিশ একপর্যায়ে তাদের ওপর গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় নিহত হন ৬৯ জন ও আহত হন ১৮০ জন। যুগে যুগে এ রকম বহু বৈষম্যের প্রতিবাদের আন্দোলনে পুলিশ গুলি ছুড়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পায় ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। তার দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে ১৯৯৪ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। শেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ নিয়ে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব শেষ হয়। কিন্তু তারপরও আদৌ আজকের পৃথিবীতে তা শেষ হয়েছে কি। আমাদের দেশে প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশরা শাসন করেছে। সাদা চামড়ার সাহেব বাবুরা বাঙালিদের খুব একটা আপন করতে পারেনি। একটা দূরত্ব ছিল কেবল চামড়ার রঙের আর ভাষার কারণে। আজও ফর্সা-কালোর সামাজিক পার্থক্য শেষ হয়ে যায়নি। বরং আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। কালো হওয়ার দায় যেন ব্যক্তির নিজস্ব আর ফর্সা হওয়ার কর্তৃত্ব যেন সবটুকুই তার।

যদিও কাগজে-কলমে এই দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা মুখে মুখে বর্ণবৈষম্য নেই নেই বলে চিৎকার করি। নিজেদের আধুনিক বলে দাবি করি। যদি তাই হতো, তাহলে আজকের সমাজে এতটা ভেদাভেদ থাকত না। উঁচু-নিচু থাকত না। গোত্রে গোত্রে হানাহানি থাকত না। বর্ণে বর্ণে প্রথায় এত ঘৃণা-বিদ্বেষ থাকত না। কিন্তু সমাজে আজও আমাদের অন্তরে তা আছে বলেই এত অন্যায়, এত অশান্তির আগুন। স্বাভাবিক দৃৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশে বর্ণবাদ নেই। গায়ের রং দিয়ে কাউকে ছোট বা বড় করার সুযোগ নেই। তবু বর্ণবাদের রেখা আছে আমাদের পরিবারে, সমাজে বা টিভির বিজ্ঞাপনে। টিভিতে সারা দিন রং ফর্সা করার ক্রিমের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। এসব বিজ্ঞাপনের বাইরেও বহু পণ্য রয়েছে যেগুলো রীতিমতো বিফলে মূল্য ফেরতের গ্যারান্টি দিয়ে রং ফর্সা করার ক্রিম বিক্রি করছে। তাও আবার নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে। একটু খোঁজ করলে আমাদের আশপাশের দোকানেই এসব পণ্য মেলে। যদি সাদা-কালো কোনো বিভেদ নাই থাকত, তাহলে ফর্সা হওয়ার বা করার এত তোড়জোড় কিসের? আসলে আমরা সমান কথাটা কেবল মুখেই বলি। অন্তরে লালন করি না। তাই মেয়েকে ফর্সা বানানোর প্রাণান্ত চেষ্টা থাকে মা-বাবার। কালো মেয়ে কোল জুড়ে এলে পরিবারের দুশ্চিন্তা হয় না-এমন পরিবার আজকের যুগেও অনেক কম আছে।

মেয়েকে শিক্ষিত করে বড় করে তোলার চেয়ে ফর্সা করা বড় হয়ে দাঁড়ায়। এর যথেষ্ট কারণও আছে। ছেলের বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ছেলের বউটা ফর্সাই আনতে চায় অধিকাংশ পরিবার। সে ক্ষেত্রে যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, সেও কিন্তু একজন মেয়ে। যার নিজের গায়ের রং হয়তো কালো সে নিজে উঠে পড়ে লাগে একটা ফর্সা ভবিষ্যৎ বংশধর বানাতে! ভাবা যায়! এমন কিছু চাকরির বিজ্ঞাপন দেখি, যেখানে সুন্দর আকর্ষণীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমাকে নিশ্চয়ই পদের নাম বলতে হবে না। মানে চেহারা সুন্দর না হলে সে পদে আবেদনই করতে পারবে না। চারদিকে কেবল বৈষম্য আর বৈষম্য। ফর্সা মানেই সুন্দর আর কালো মানেই অসুন্দর। ফর্সা ছেলেমেয়ে হলেই চাঁদের মতো সুন্দর আর কালো হলেই ভ্রুটা একটু কুঁচকে যায়। আমরা যতই জোর গলায় চিৎকার করি না কেন, কোনো লাভ নেই। কারণ মন থেকে যত দিন সাম্য না আনব, তত দিন কোনো লাভ হবে না। রবীন্দ্রনাথের গানের কৃষ্ণকলি কেবল গানেই সুন্দর, বাস্তবে তার উপস্থিতি ততটাই ক্ষীণ। কৃষ্ণকলিদের মর্যাদা আমাদের সমাজে নেই। তারাও কৃষ্ণকলি থেকে উত্তরণের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে যায়। ক্রিমের পর ক্রিম, নানা ভেষজ আরো কত কী থাকে! বর্ণবাদ বহু আগেই শেষ হয়েছে বলে আমরা গলা ফাটিয়ে বলি আসলে তা শেষ হয়নি। বর্ণবাদ ছিল এবং আজও আছে নতুন রূপে। ক্ষেত্রবিশেষে আরো প্রকট। বর্ণবাদের এই জুজু কোনোদিনই শেষ হবে না, যত দিন আমরা নিজেরা না বদলাব।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close